শিল্পী রাণী হালদার: মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। অথচ এই মানুষের মধ্যেই যত ভেদাভেদ, যত শ্রেণী বৈশম্য। আর এই শ্রেণী বৈষম্যের শিকার আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ যাদেরকে আমরা হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বলে থাকি। হিজড়াদের বিরক্তি বা আতঙ্ক হিসেবে দেখেন না এমন মানুষ খুঁেজ পাওয়া কষ্টকর। মানুষ হয়েও, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সবখানে তারা কেবল অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের শিকার।
জন্মগত ভাবে হিজড়ারা স্বাভাবিক মানুষের মত নয়। ঠিক যেমন একজন প্রতিবন্ধী। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের কেউ সমাজ ছাড়া করে না। তবে আমরা দেখি কারো ঘরে হিজড়া সন্তান জন্ম নিলে সভ্য সমাজে তার কোন ঠাঁই মেলে না। পরিবার থেকে শুরু করে প্রতিবেশী, আতœীয় স্বজন সবাই অমানবিক আচরণ করে থাকে। একজন হিজড়াকে পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষাসহ সকল প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাই তারা বাধ্য হয়ে আলাদা সমাজ গড়ে তুলে, যা সভ্য সমাজ থেকে একটু ভিন্ন।
বাঘা উপজেলার অন্তর্গত আড়ানী পৌর-বাজারে অবস্থিত লাইট হাউজ নামে “এ জীবন বদলে দাও” সংগঠনের পরিচালক একরাম আলী (আকলিমা) বলেন বাঘা, পুঠিয়া, আড়ানী মিলে আমাদের লাইট হাউজের সদস্য মোট ১০০ জন। তিনি এ সংগঠনের গুরু দ্বায়িত্ব পালন করছেন। লাইট হাউজ এর কয়েকজন হিজরা জানান তাদের সমস্যার কথাগুলো।
কাজল জানান, হিজড়া হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে অনেক ছোট বড় কথা শুনতে হয় তাকে। নানা প্রতিকুলতার মাঝে কাজল লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছেন ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত। তারপর নানা সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। তারপর ২০১০ সালে লাইট হাউজে কাজ শুরু করেন তিনি। লাইট হাউজে এমনো অনেক হিজড়া আছেন যারা পরিবার থেকে বিতাড়িত। হিজড়া হবার কারণে পরিবারে ঠাঁই হয়নি তাদের। তাই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাইরে জীবন ধারণ করছেন অনেক দিন। তারপর লাইট হাউজের কথা জানতে পেরে এখানেই কাজ শুরু করেন। লাইট হাউজে ১০০ জন হিজড়ার মধ্যে ভাতা পাচ্ছেন ৩৪ জন। তাদের ভাতার পরিমান মাসিক ৬০০ টাকা আর মাসে ২ বার চিকিৎসা সেবা পান বিনামূল্যে। আকলিমার দলের সাথে যারা আছেন তারা সবাই কাজ করে খায় কিন্তু তারা যে কাজ করছে তাতে অনেক বাজে কথা শুনতে হয় তাদের।
এদের মধ্যে কেউ কেউ কৃষি কাজও করেন। আবার মঞ্চে নাচ গান করে যে টাকা আয় করে তা দিয়ে কোন রকম চলে যায় তাদের। কিন্তু তাদেরও যে সুষ্ঠ সুন্দরভাবে বেঁেচ থাকার অধিকার আছে তা যেন কেও মানতে নারাজ। হিজড়াদেরকে বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দিলেও তাদের প্রতি এখনো বদলাই নি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। তবে লিঙ্গ বৈষম্য দুর করলে সমাজ ও দেশ এগিয়ে যাবে এমনটাই মনে করেন হিজড়া জনগোষ্ঠীরা। বর্তমান সময়ে এসেও হিজড়াদের দুঃখ-দুর্দশা ও বিড়াম্বনার যেন শেষ নেই। লোক লজ্জার ভয়ে হিজড়া পরিচয়ে স্কুলেও যেতে পারছে না কোন কোন শিশু। অনেক হিজড়া এখনো স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন ভাতা হতেও বঞ্চিত। হিজড়া হওয়ার কারণে মিলছেনা কোথাও কাজের সুযোগ।
মানুষ হিসাবে জন্ম তবুও প্রকৃত মানুষের অধিকার নিয়ে বাচঁতে পারছি না আমরা। “আমরা চাই সরকার আমাদের কর্মসং¯থানের সুযোগ করে দিক তাহলে কোনো হিজড়াকে আর ভিক্ষা করতে দেখবেন না” আমরাও পরিশ্রম করে অন্য দশজন মানুষের মত স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে চাই। বলছিলেন হিজড়া সংগঠেনর প্রধান আব্দুল সবুর মিঞা। আমরা এ সমাজেরই ১টা অংশ। তাই আমাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে, কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আর এমনটি করলেই তারা সমাজের বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে বলে মনে করেন হিজড়া জনগোষ্ঠীরা।
খবর৭১/ইঃ