আসাদুল ইসলাম সবুজ, লালমনিরহাট প্রতিনিধি: মাইদুলের স্বপ্ন ছিল একদিন বড় হয়ে মানুষের জন্য কাজ করবে। সে কারণে তার বড় ইচ্ছে লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হওয়া। কিন্তু তাকে প্রায় তিন কিলোমিটার পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। সে কারণে তার প্রয়োজন একটি বাই সাইকেল। দিন মুজুরের ছেলে মাইদুল বাইসাইকেলে করে স্কুলে যাবে না। তার ইচ্ছে ঘোড়ায় চড়ে সে তার স্কুলে যাবে। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরন হয়েছে। সে এখন ঘোড়ায় চড়ে বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যায়। উত্তর জনপদের জেলা লালমনিরহাটের সীমান্তবর্তী এসব এলাকায় বেশির ভাগ পরিবারের সন্তানরা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায় রিকশা, বাইসাইকেল অথবা অভিভাবকের মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে। তিস্তা চরাঞ্চলে নদী পাড়ের শিশুরা স্কুলে যায় নৌকা অথবা ভেলায় চড়ে।
কিন্তু এক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের দিনমজুরের ছেলে মাইদুল ইসলাম তাদের থেকে একটু ব্যতিক্রম। সে তার স্কুলে যায় ঘোড়ায় চড়ে। চন্দ্রপুর আদর্শ বিদ্যা নিকেতনের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মাইদুল। ঘোড়ায় চড়ে প্রতিদিন ৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যায় মাইদুল।
স্থানীয় লোকজন জানায়, কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের খামারভাতি গ্রামের দিনমজুর লিয়াকত আলীর ছেলে মাইদুল। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মাইদুল মেজো। পড়াশুনা করে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে মাইদুল। ডাক্তার হয়ে একদিন তার এলাকার গরীব পরিবার গুলোর বিনা টাকায় চিকিৎসা দেবে।
মাইদুলের পরিবার জানায়, মাইদুলের দাদার একটি ঘোড়া ছিল। দাদা তাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে ঘুরাতেন। ৫ম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাইদুলের ঘোড়ার প্রতি মাইদুলের একটা ভালোবাসা জন্মায়। পরবর্তীতে অভাবের তাড়নায় মাইদুলের বাবা ঘোড়াটি বিক্রি করে দেন। ঘোড়া বিক্রি করার পর থেকে মাইদুল ইসলাম আর স্কুলে ঠিক ভাবে যায় না। এমনকি সে এক সময় খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে দেয়। ঘোড়ার জন্য প্রায় সময় কাঁদতে শুরু করে মাইদুল। সেই সঙ্গে ঘোড়াটি ফিরিয়ে আনার জন্য বাবার কাছে কাকুতি-মিনতি করে। প্রতিদিন সন্তানের কান্না দেখে দিনমজুর বাবা লিয়াকত আলী অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে ও অন্যের কাছে কিছু কর্জা নিয়ে স্থানীয় বালাপাড়া হাট থেকে একটি ঘোড়ার বাচ্চা কিনে আনেন। বাচ্চাটি দেখে খুশিতে মেতে ওঠে মাইদুল। সেই সঙ্গে ঘোড়ার বাচ্চাটি লালনপালন করতে থাকে সে। দিন চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে ঘোড়ার বাচ্চাটি। এরই মধ্যে ঘোড়ার বাচ্চাটির নাম রাখা হয় বাহাদুর। মাইদুলের স্বপ্ন ছিল, বাহাদুর বড় হলে একদিন তার পিঠে চড়ে সে স্কুলে যাবে। অবশেষে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন সে প্রতিদিন ঘোড়ার পিঠে চড়ে ৩ কিলামিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যায়।
মাইদুল ইসলাম জানায়, ঘোড়া পিঠে প্রথম যেদিন স্কুলে যাই সেদিন থেকে স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা আমাকে এক নামে চেনেন। আমি প্রতিদিন ঘোড়ায় চড়ে স্কুলে যাই। স্কুলে বাহাদুরকে দেখে সবাই আনন্দ পায়। আমার বন্ধুরা ঘোড়ার পিঠে উঠতে চাইলে তাদেরকেও উঠাই। এখন আমার ইচ্ছা পড়াশোনা করে একজন ভাল ডাক্তার হওয়ার।
মাইদুল ইসলামের বাবা লিয়াকত আলী বলেন, দাদার ঘোড়াটি বিক্রির পর অনেক কেঁদেছে মাইদুল। পরে দিনমজুরির টাকা জমিয়ে ও কিছু কর্জা করে অনেক কষ্ট করে তাকে একটি ঘোড়া কিনে দিই। যেদিন ঘোড়ার বাচ্চাটি কিনে বাড়িতে নিয়ে আসি, ওইদিন ঘোড়া দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় মাইদুল। সে ঘোড়াটি নিজেই লালনপালন করে বড় করেছে। এখন সে ঘোড়ায় চড়ে প্রতিদিন স্কুলে যায় মাইদুল। তার স্বপ্ন বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে। আমি যতদূর পারি দিনমজুরি করে ছেলেকে পড়াশোনা করাব।
চন্দ্রপুর আদর্শ বিদ্যা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হক বলেন, মাইদুল ইসলাম দিনমজুরের ছেলে হলেও সে খুব মেধাবী। সে ঘোড়া নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে আসে। তার ঘোড়াটি দেখে সবাই আনন্দ পায়। স্কুলের অনেক ছাত্রই তার ঘোড়ার পিঠে চড়ে। দেখতে আমারও বেশ ভালো লাগে। কিন্তু তার ডাক্তর হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। কারন তার বাবা দিন মুজুরী করে তার লেখা পড়ার খরচ চালাতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে সমাজের কোন বিত্তবান ব্যক্তি যদি এগিয়ে আসে তাহলে হয়তো সে তার কাঙ্খিত জায়গায় পৌছেতে পারবে।