এম শিমুল খান,গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি : গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রামের কিশোর আরমানুল ইসলাম। উড়োজাহাজ বানিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তিনি। শুধু প্লেন দেখতে নয়, তাকে দেখতেও প্রতিদিন ভিড় করছেন আশ পাশের গ্রামের মানুষ। আরমানুল ইসলাম জেলার কাশিয়ানী উপজেলার পুইশুর ইউনিয়নের মো: হাফিজুর রহমান সমাদ্দারের একমাত্র ছেলে। তিনি একই উপজেলার রামদিয়া এস কে কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
২০০১ সালের ১ আগস্ট রাজবাড়ী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আরমান। বাবার চাকরির সুবাদে ২০১৭ সালের বাগেরহাট জেলার বেতাগা ইউনাইটেড হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। তার বাবা বর্তমানে বাগেরহাটের মংলায় ব্র্যাক এনজিও’তে মাঠকর্মী হিসেবে কর্মরত আছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও আরমানুল ইসলাম পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্ভাবনী কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে বলে জানালেন তার কলেজের অধ্যক্ষসহ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরমানের এ আবিষ্কার দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল প্লেন বানানোর। আর তাই তখন থেকেই সোলা দিয়ে ছোট ছোট প্লেন বানিয়ে উড়ানোর চেষ্টা করতেন আরমান। নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন একটি প্লেন বানানোর মনস্থির করেন আরমান। কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে পেরে উঠেনি। এসএসসি পাস করার পর গ্রামের বাড়িতে চলে আসতে হয় তাকে। আর তাই বাড়ির পাশের রামদিয়া এস কে কলেজে ভর্তি হওয়া। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর প্রবল ইচ্ছা শক্তির কারণে পরিবার থেকে তাকে পেন বানানোর জন্য সাড়ে ১২ হাজার টাকা দেয়। আর এ টাকার একটি বড় অংশ দেন তার দাদি হাফিজা বেগম। বাকি টাকা দেন তার বাবা এবং তার সহযোগী সিতারামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জাসিয়া আকতারের বাবা দুবাই প্রবাসী এনামুল হক।
গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে শুরু হয় আরমানুলের পেন বানানোর কাজ। সপ্তাহ দুয়েক চেষ্টার পর অবশেষে গত ৮ জানুয়ারি পরীক্ষামূলক আকাশে উড়ে তার পেন। ওই দিনই বাড়ির পাশের মাঠে উড়ানো হয় পেনটি। উড্ডয়নের পর প্রায় ১৫ মিনিট আকাশে উড়তে সক্ষম হয় তার পেনটি। এরপর একই মাঠে অবতরণ করা হয় এটি। বিপুল সংখ্যক মানুষ তার পেনটি আকাশে উড়া দেখতে ভিড় করেন। হতবাক হয়েছেন তারা এ কিশোরের আবিষ্কার করা পেন আকাশে উড়তে দেখে।
ক্ষুদে উদ্ভাবক আরমানুল ইসলাম দাবি করলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চীন ও আমেরিকার মতো উন্নত প্রযুক্তির মনুষ্যবিহীন পেন ও ড্রোন বানাতে পারবেন তিনি, যা গোয়েন্দা কাজে, সেনাবাহিনীর কাজের ক্ষেত্রে এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যাবে। তিনি আরো বলেন, আমার ইচ্ছা ভবিষ্যতে পাইলট বা ড্রোন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। তবে সরকারের সহযোগিতা আমার খুব প্রয়োজন। কারণ, আমার পরিবারের স্বচ্ছলতা নাই যে, আমাকে এ সব কাজে সহযোগিতা করবে।
আরমানুল ইসলাম আরো জানালেন, তার আবিষ্কৃত পেনটির ওজন ৮’শ গ্রাম, দৈর্ঘ্য ৩৬ ইঞ্চি ও উইং ৫০ ইঞ্চি। পেনটিতে ব্র্যাশ লেস ডিসি মটর ব্যবহার করা হয়েছে। মটরের স্পিড কন্ট্রোল করার জন্য ইলেকট্রিক স্পিড কন্ট্রোলের সঙ্গে আরো ৪টি সারভো মটর লাগানো হয়েছে। ইলেকট্রিক স্পিড কন্ট্রোল মেইন মটরকে কন্ট্রোল করে। সারভো মটর এলোরন অ্যালিভেটর এবং রাডার কন্ট্রোল করে। পেনটিতে সিক্স চ্যানেলের একটি প্রোগ্রামেবল রিমোট সংযোজন করা হয়েছে। পেনটি দেড় কিলোমিটার রেঞ্জে চলতে পারে। তবে প্রযুক্তি ব্যবহার করলে রেঞ্জ আরো বাড়ানো সম্ভব বলেও দাবি আরমানের।
তার সহযোগী জাসিয়া আকতার বলেন, আরমান ভাইয়ের খুব শখ ছিল একটা পেন বানিয়ে আকাশে উড়ানোর। বিষয় গুলো সে আমার সঙ্গে শেয়ার করত। এরপর আমিও তার এ কাজে সহযোগিতা করার ইচ্ছা পোষণ করি। তারপর তার সঙ্গে পেন বানাতে কাজ করি। তিনি আরো জানান, পেন আকাশে উড়ার পর তার খুব ভালো লেগেছে। ভবিষ্যতে সে দেশের জন্য কাজ করতে চায় বলেও জানায় জাসিয়া।
আরমানের মা রেহানা পারভীন বলেন, ছোটবেলা থেকে ছেলের সৃজনশীল কাজের প্রতি অনেক ঝোঁক। স্কুল জীবনে বিভিন্ন সময় বিজ্ঞান মেলায় সে অনেক কিছু উদ্ভাবন করেছে। তাতে পুরস্কারও পেয়েছে। আর ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল একটি পেন বানানোর। কিন্তু তার জন্য যে টাকার প্রয়োজন, তা দেওয়ার সামর্থ আমাদের ছিল না। পরে ওর দাদু, বাবা ও জাসিয়ার বাবার সহযোগিতায় টাকা জোগাড় হয়। তিনি আরো বলেন, গত নভেম্বর মাসে ওই টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে পেন বানানোর বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হয়। বাড়িতে এসে দুই সপ্তাহ লেগেছে পেনটি বানাতে। সত্যিই আমি গর্বিত।
রামদিয়া এস কে কলেজের শিক্ষার্থী শেখ হাসান ও মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আরমান অনেক মেধাবী ছেলে। সে অনেক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে পেন বানিয়েছে। এই কলেজের ছাত্র হিসেবে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি।
কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান নিত্যানন্দ রায় বলেন, আমরা যখন জানতে পারলাম ছেলেটি একটি পেন বানাতে চায়। তখন তাকে পেন বানানোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে কলেজের পক্ষে যে সব সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল তা করেছি। পরে শুনতে পারলাম ছেলেটি একটি পেন বানিয়েছে এবং আকাশে উড়িয়েছে। এতে আমরা গর্বিত।
কলেজের অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আমরা অভিভূত। এ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আরমানুল ইসলাম পেন বনিয়েছে। আর সেই পেন একই কলেজ মাঠে উড়িয়েছে। সত্যিই অনেক ভাল লেগেছে। আমরা কলেজ থেকে যতটুকু সম্ভব তার পড়াশোনার পাশাপাশি তার বিভিন্ন উদ্ভাবনী কাজে সহায়তার চেষ্টা করব।
খবর ৭১/ ই: