খবর৭১: নানা কারণে ঢাকা বিভাগের ৫১৩টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে পোশাকখাত মূল্যায়নে জাতীয় উদ্যোগের আওতায় অনেক কারখানাও রয়েছে। আবার মূলধন ঘাটতি ও পর্যাপ্ত কার্যাদেশ না পাওয়ার কারণে লোকসানে থাকা অনেক কারখানাও মালিকরা চালাতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি বেশের বিকাশমান তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য ইতিবাচক নয় বলে মনে করছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় উদ্যোগে কর্মসূচির হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ পোশাক কারখানাই এখন বন্ধ। জাতীয় উদ্যোগে পোশাকশিল্প মূল্যায়ন কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে প্রায় দেড় হাজার কারখানা। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের সব জেলায় এসব কারখানার বিভিন্ন ত্রুটি এরই মধ্যে শনাক্ত হয়েছে। প্রাথমিক পরিদর্শনের পর ঝুঁকির মাত্রাভেদে এক হাজার ৫৪৯টি কারখানাকে গ্রিন, ইয়েলো, অ্যাম্বার ও রেড শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। গ্রিন শ্রেণীভুক্ত কারখানাগুলো নিরাপদ আর রেড শ্রেণীর কারখানাগুলো অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত চার বছরে রেড শ্রেণীভুক্ত মোট ৫১৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা অঞ্চলের ৩৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ কারখানাই বন্ধ হয়েছে গত চার বছরে। জাতীয় উদ্যোগের আওতায় কারখানার প্রাথমিক পরিদর্শন ও পরবর্তী সংস্কার কার্যক্রম কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিদর্শক সামছুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, মোট ৫১৩টি কারখানার কয়েকটি আমাদের নির্দেশনায় বন্ধ হয়েছে। অনেক কারখানাই শিল্প বিপর্যয়-পরবর্তী প্রেক্ষাপটের প্রভাবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বন্ধ হয়েছে। এখন আমাদের উদ্বেগ সেসব কারখানা নিয়ে, যেগুলো ত্রুটি নিয়ে সচল আছে, কিন্তু সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করছে না। যথাযথভাবে সংস্কার সম্পন্ন না করলে এমন প্রায় ৮০০ কারখানা আইন অনুযায়ী বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অনুসন্ধানে কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। মোটা দাগে তাজরীন ও রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর কারখানার সার্বিক মান বা কমপ্লায়েন্স নিয়ে ক্রেতাদের সতর্কতাই ছিল কারখানা বন্ধের মূল কারণ। ওই দুই ঘটনার প্রভাবে কারখানাগুলোর কার্যাদেশ কমে যায়। কার্যাদেশের অভাবে অনেক কারখানাকেই লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তাই কারখানা বন্ধের সুনির্দিষ্ট কারণগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশিরভাগই বন্ধ হয়েছে কার্যাদেশ না থাকার পাশাপাশি লোকসানের কারণে। এছাড়া আনুষঙ্গিক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে রয়েছে আর্থিক অসচ্ছলতা, ব্যাংকের কাছে দেনা, কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়া, গ্যাস সংকট, অগ্নিকাণ্ড, কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, কারখানার জমির মালিককে ভাড়া না দেয়া, পুরনো মেশিন ও শ্রমিক অসন্তোষ।
শিল্পসংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড় সব ধরনের কারখানাই রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক কারখানা রয়েছে, যারা কাজ করত সাব-কন্ট্রাক্ট পদ্ধতিতে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি আবার বিজিএমইএ বা অন্য কোনো সংগঠনের সদস্য নয়। রানা প্লাজা দূর্ঘটনার পর কারখানা মূল্যায়ন শুরু হলে সাব-কন্ট্রাক্টে চলা অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে।
পোশাকখাতের মালিক প্রতিনিধিদের সংগঠন বিজিএমইএ এক কর্মকর্তা বলেন, পোশাকশিল্প মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। জাতীয় উদ্যোগের আওতায় থাকা যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে, সেগুলো পোশাকখাতের রপ্তানিতে তেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। কারণ এসব কারখানার অনেকটাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি। বেশিরভাগই পুরনো কারখানা। এগুলো রিমেডিয়েশন বা রিলোকেশন করা সম্ভব হয়নি। এ ধরনের প্রতি ১০টি কারখানা বন্ধ হয়ে সমন্বিত উৎপাদন সামর্থ্যরে একটি কারখানা অন্যত্র গড়ে উঠেছে। তাই এ বন্ধের প্রভাব গোটা পোশাকখাতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, তাজরীন ও রানা প্লাজা দূর্ঘটনার পরবর্তী প্রেক্ষাপটে পোশাকশিল্পের কারখানাগুলোয় কর্মসংস্থান সংকটের মুখোমুখি হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এসব শ্রমিকের মধ্যে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। অনেকে কাজ নিয়েছেন একই বা অন্য শিল্পকারখানায়। অনেকে পেশাও পরিবর্তন করেছেন।
সূত্রমতে, জাতীয় উদ্যোগের আওতায় এক হাজার ৫৯৪টি কারখানার মধ্যে ঢাকা বিভাগের মোট কারখানার সংখ্যা এক হাজার ৩১৯। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ৬৪৯টি, নারায়ণগঞ্জে ৩৯৮ ও গাজীপুরে ৩৭২টি। এদিকে চার বছরে বন্ধ ৫১৩টি কারখানার মধ্যে ঢাকার ২৭৬, নারায়ণগঞ্জের ২৯৮ ও গাজীপুরের কারখানা ৮৮টি। এ হিসাবে বন্ধ কারখানার ৪৫৫টিই ঢাকা বিভাগের।
উল্লেখ্য, সত্তরের দশকের শেষভাগে শ্রমঘন শিল্প হিসেবে দেশে পোশাকখাতের গোড়াপত্তন হয়। গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক কারখানা। তবে এসব কারখানা গড়ে ওঠে মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামকে ঘিরে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এ শিল্পে ২০১২ ও ২০১৩ সালে নেমে আসে তাজরীন ও রানা প্লাজায় দূর্ঘটনার মতো বিপর্যয়। এরপর খাতটির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুরু হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগে মূল্যায়ন কর্মসূচি।
খবর৭১/এস: