আসাদুল ইসলাম সবুজ, লালমনিরহাট: লালমনিরহাটে ইটভাটাগুলোতে প্রতি মৌসুমে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১৯ কোটি পিস ইট। এবার ইট উৎপাদনের টার্গেটে প্রায় ১কোটি সিএফটি মাটি পোড়ানো হচ্ছে। এসব সিংহভাগ মাটি আসছে কৃষি জমি থেকে। কৃষি জমির মূল্যবান অংশ ‘টপ সয়েল’ হিসেবে পরিচিত এ মাটি ইটভাটা গুলোর পেটে গেলেও এ নিয়ে তেমন তাপ-উত্তাপ নেই কোনো প্রতিষ্ঠানেরই। ফলে কৃষি জমির টপ সয়েলের বিনাশ করা হলে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে। অথচ ইটভাটার সর্বশেষ আইন অনুযায়ী কৃষিজমির মাটি ভাটায় ব্যবহার নিষিদ্ধ। পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষক ও কৃষি বিভাগ, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ইটভাটা মালিকসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলে।
একটি সূত্র মতে, লালমনিরহাট জেলায় ২৭টি ইটভাটা রয়েছে। তারমধ্যে ৫টি ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তর বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও তা চালু রাখা হয়েছে। ‘কৃষিতে ইটভাটার প্রভাব’ বিষয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর প্রতিবেদন প্রকাশ হলে ক্ষতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন সম্ভব হবে। কৃষি জমির ‘টপ সয়েল’ নিয়ে এই উদ্বেগ সম্পর্কে ধারণা নেই কৃষকদের। তারা সামান্য প্রয়োজনে বা কোনো প্রয়োজন ছাড়াই মাটির উপরিভাগ তুলে দিচ্ছেন ভাটা মালিকদের কাছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল ধারণা থেকেও তারা মাটি বিক্রি করছেন। ইটভাটায় ‘টপ সয়েল’ বিক্রি নিয়ে লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ খবর নিয়ে নানা চিত্র উঠে এসেছে। কোথাও কৃষককে বোঝানো হয়, তোমার জমি উঁচু, সেচের পানি নেমে যাবে, বোরো আবাদ হবে না। তাই উপর থেকে মাটি ভাটায় বিক্রি করে দাও। কোথাও বলা হয়, উপরের মাটিতে ভাইরাস-ময়লা। উপরের মাটি বিক্রি করে নিচের ‘ভাল’ মাটিতে চাষ করলে ভালো ফসল হবে। এভাবেই নানাভাবে কৃষককে বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করা হয় ‘টপ সয়েল’ বিক্রির জন্য। আর এ কাজে সক্রিয় রয়েছে ভাটায় মাটি সরবরাহকারী কন্টাক্টররা।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সিঙ্গিমারী গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, জমির উপরের মাটিতে ময়লা-ভাইরাস থাকে। এ জন্য তিনি উপর থেকে মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দিয়েছেন। একই ধরনের বক্তব্য ওই উপজেলার নাওদাবাস গ্রামের কৃষক আশরাফ হোসেনেরও। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চামটাহাট এলাকার কৃষক সাদেকুল ইসলাম জানান, তার জমিটি আশপাশের জমি থেকে কিছুটা উঁচু। শ্যালো মেশিন মালিক উঁচু জমিতে সেচের পানি দিতে চায় না। আবার উঁচু জমিতে পানি বেশিক্ষণ ধরেও রাখা যায় না। এ জন্য তিনি উপর থেকে মাটি বিক্রি করে ‘জমি সমান’ করছেন। মাটি কেটে নিলে জমির কিছুটা ক্ষতি হয় তা তিনিও জানেন। সার-মাটি দিয়ে তা পুষিয়ে নেবেন বলে জানান তিনি।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, জমির উবর্রতা শক্তি ১৫-২০ ইঞ্চির মধ্যে থাকে। এই অংশে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়ামসহ বিভিন্ন উপাদান থাকে। এই উপাদান গাছকে ঘন সবুজ রাখে, শিকড় বিস্তারে সহায়তা করে, সময়মতো ফুল ফোটায় ও ফসল পাকায়, ফসলের গুণগত মান বাড়ায়, ডাল ও ফসলের ফলন বাড়ায়, শস্যের দানা পুষ্ট করে এবং উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। তাই ওপর থেকে মাটি সরিয়ে ফেলায় উবর্রতা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় সেই জমির ওপর বিভিন্ন পদার্থ জমে উবর্রতা শক্তি ফিরে আসতে শুরু করে। এভাবে আগের মতো উবর্রতা শক্তি ফিরে আসতে কমপক্ষে ১০-১৫ বছর সময় লাগে। আর এভাবে মাটি বিক্রি অব্যাহত থাকলে একসময় ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
লালমনিরহাটের ইট প্রস্তুতকারীদের তথ্য অনুযায়ী, গড়ে ভাটা প্রতি ৬০ লাখ হিসেবে ধরলে জেলায় ৩১টি ইটভাটা থেকে প্রতি মৌসুমে প্রায় ১৯কোটি পিচ ইট উৎপাদিত হয়। আর এ জন্য প্রতি ভাটায় ৭ থেকে সাড়ে ৮ হাজার ট্রাক মাটি দরকার হয়। এতে মাটি পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি সিএফটি। অথচ, ইটভাটার সর্বশেষ আইন অনুযায়ী, কৃষি জমির মাটি ভাটায় ব্যবহার নিষিদ্ধ। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ এ উল্লেখ রয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হইতে মাটি কাটিয়া বা সংগ্রহ করিয়া ইটের কাঁচামাল হিসাবে উহা ব্যবহার করিতে পারিবেন না।’ এই আইন লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদন্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে বিধান রয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) বিধু ভূষন রায় বলেন, মাটির জৈব ও পুষ্টি উপাদান উপরিভাগের ৩ থেকে ৫ ইঞ্চির মধ্যে বিরাজমান। ফলে এই মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া যে কি ভয়াবহ ক্ষতি তা কৃষকরা জানেন না। এ জন্য কোনো কারণ ছাড়াই বা সামান্য কারণেও তারা মাটির উপরিভাগ ইটভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছে। অথচ এই টপ সয়েল পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ১৫ থেকে ২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। তাই কৃষি জমি রক্ষায় কৃষকদের এই মারাত্মক প্রবণতা থেকে সরিয়ে আনা দরকার।
জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হাকিম বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম মেনেই আমরা ইটের জন্য মাটি সংগ্রহ করি। পাশাপাশি জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকি। আমরা যা করছি, তা তো উন্নয়নের জন্য করছি। অনেকেই নিয়ম মেনে মাটি সংগ্রহ করছে না সেটা আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, কৃষকদের মাটি বিক্রি না করার বিষয়ে সচেতন করার পরও তারা আমাদের কথা শুনছেন না। নগদ টাকার আশায় তারা মাটি বিক্রি করছেন। মাটি বিক্রি করে সাময়ীক অভাব দূর হলেও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
খবর ৭১/ এস: