চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধিঃ মোমেনা খাতুন ও শুকুরন নেছা। মহান মুক্তিযুদ্ধের দুই বীরাঙ্গনা। এই বীর নারীরা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় পাকিস্তান সেনাদের নির্যাতনের স্বীকার। ৭১‘র সেই বিভৎস ঘটনা এখনও তাদের তারা করে। দেশ মাতৃকার যুদ্ধে হার না মানা এই নারী বীরাঙ্গনারা হলেন চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার পৌর এলাকার ক্যানাল পাড়ার শুকুরন নেছা ও হারদি গ্রামের মোমেনা খাতুন ।।
মোমেনা খাতুন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। সুদর্শন ফুটফুটে এক যুবতী। পাক সেনাদের চোখ পড়ে তার উপর। সেই থেকে শুরু। দিনের পর দিন তাদের লালসার শিকার হতে হয়েছে। একদিকে তাদের মনোরঞ্জনের বলি অন্যদিকে মারধরের সম্মুখিন হতে হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর মানুষের লাঞ্ছনা,ঘৃণা আর অপবাদ তাকে বিষিয়ে তুলে। কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইতো না। অবশেষে ১৯৭৭ সালে বিবাহে আবদ্ধ হোন রেজাউল করিম রুনে নামে এক সরকারি চাকুরীজীবী । সেই থেকে মোমেনার পিতার ভিটা বাড়ী হারদী গ্রামে বসবাস করে আসছেন এই দম্পিতি। দাম্পত্যজীবনে তার কোল জুড়ে জন্ম নেয় একে একে দশটি সন্তান। ৭১‘র সেই বিভৎস ক্ষতর কারণে ঝড়ে যায় সাতটি প্রাণ। মামুনুর রহমান,মাসুদুর রহমান ও মাহাবুবর রহমান শান্ত নামে ৩ সন্তান এখন জীবিত। এদের মধ্যে বড় ছেলে মামুনুর রহমান বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। মেঝে ছেলে মাছুদ ৯ বছর ধরে নিখোঁজ। আর ছোটছেলে শান্ত সঙ্গীত শিল্পী। মোমেনার বয়স এখন ষাট্র এর কোটা পেরিয়েছে। নিজে ক্যান্সারের রুগী। স্বামী ফুসফুস রোগে আক্রান্ত। পিতার ভিটা ছাড়া তাদের নিজের বলতে কিছু নেই। ৪৫ বছর কেউ তাদের খবর রাখেনি। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে তিনি নারী মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে গেজেট ভূক্ত হয়েছেন। এবছর থেকে ভাতাও পাচ্ছেন। বর্তমান সরকার তাকে সম্মনিত করা সে দারুন খুশি। এ জন্য তিনি সরকার প্রধানকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলেন, আল্লাহ যেন আমার জীবন নিয়ে হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখেন।
শুকুরন নেছা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২২ বছর। ২ সন্তানের জননী। থাকতেন আলমডাঙ্গা শহরের হাবিব ব্যাংকের পাশে। পাক বাহিনীর ভয়ে পাশ্ববর্তী গ্রামে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তার সাথে ছিল ওই ব্যাংকের নুরু পিয়নের স্ত্রী রাবেয়া। পথি মধ্যে পাক সেনারা তাদের ধরে নিয়ে যায় ক্যানাল পাড়ার আহসানের বাড়িতে। সেখানে ৪জন পাকসেনা ও ৬/৭জন রাজাকার ছিল। ২জন পাক সেনা তাদের উপর নির্যাতন চালায়। একই দিন বিকালে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ৭১‘র টর্সার সেল খ্যাত লালব্রীজের নীচে। পরে একটি মাটির গর্তে তাদের নামানো হয়। মৃত্যু নিশ্চিত যেনে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি। সামনে তাকাতেই দেখি ট্রেন থেকে বহু নারী-পুরুষকে নামিয়ে টর্সার সেলর দিকে আনা হচ্ছে। এমন সময় পিচ কমিটির চেয়ারম্যান মালেক মিয়াসহ ইউছুফ মিয়া ও আহম্মেদ বিশ্বাস লালব্রীজ থেকে আমাদের ছাড়িয়ে আনে। তারপর আমরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায়।
এই দুই বীরাঙ্গনা দেশ মাতৃকার রক্ষার স্বার্থে জীবনের বড় সম্পদ বিসর্জন দিলেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি নিজস্ব ঘরবাড়ি। এর মধ্যে মোমেনা থাকেন শ্বশুড়ের ভিটেই আর শুকুরন থাকেন সরকারি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবৈধ জমিতে ক্যানালের ধারে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে দুই বীরাঙ্গনার মধ্যে মোমেনার ভাগ্যে ভাতা জুটছে। তবে শুকুরন নেছা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হলেও আজ ভাতা পাননি ।
বীরাঙ্গনা মোমেনার স্বামী রেজাউল করিম রুন বলেন, ৭১‘র মুক্তিযুদ্ধে আমার স্ত্রী নির্যাতিতা নারী। এতে আমি অখুশি নয়। এদের কারনেই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছি। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।
আলমডাঙ্গা উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী শেখ নুর মোহাম্মদ জকু বলেন, দীর্ঘদিন পর হলেও সরকার ২ জন বীরঙ্গনা নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এতে খুবই আনন্দিত হয়েছি। তাঁদের এই স্বীকৃতি নারী জাতিকে সম্মানিত করেছে। তবে আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করছি বীরঙ্গানা হওয়া সত্বেও এখন পর্যন্ত তারা পুরোপুরি আর্থিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেনা।
আলমডাঙ্গা উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা আবু তালেব বলেন,মোমেনা খাতুন ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট ভূক্ত হন। তাঁর গেজেট নং ১৬৯। অপরদিকে শুকুরন নেছা একই বছর ১ সেপ্টেম্বর গেজেট ভূক্ত হন। তার নিরিয়াল নম্বার ১৩৪। তবে তিনি ভাতা এখনও না পেলেও বকেয়াসহ সব পাবেন।
আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহাত মান্নান বলেন, আমার উপজেলায় দুইজন বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তার মধ্যে একজন ভাতা পান। অন্যজন পাননা। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরন করা হয়েছে। আশাকরি দ্রুত তিনি ভাতা সুবিধার আওতায় আসবেন। এ দুজনের নিজস্ব কোন সম্পতি নেই। সে কারণে বাড়ি তৈরী করে দেওয়া যাচ্ছেনা। ভাতা সুবিধা পেলে আমরা সহায়তা দিয়ে জমি ক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
খবর৭১/এস: