খবর৭১:যমুনা নদীর বাম তীর সংরক্ষণে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেয়া প্রকল্পের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে। দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য আলাদা প্রকল্প দুটি অনুমোদনের ৩ মাসের মধ্যে কাজ শুরুর নির্দেশ দেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তার কার্যালয় থেকে প্রকল্পের কাজগুলো সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করে বিভিন্ন ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়।
কিন্তু গত প্রায় ৪ মাসে এ সংক্রান্ত কাজের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। উল্টো পানি উন্নয়ন বোর্ড বিনা টেন্ডারে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের কাজ দেয়ার আয়োজন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ড আগেও এ কাজ করেছে। এ পদ্ধতিতে কাজ দেয়ার জন্য দরপত্র দিতে হয় না। পছন্দের লোককে বিনা টেন্ডারে কাজ দেয়ার সুযোগ আছে। টেন্ডার ছাড়া কাজ দেয়া হলে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে এ পদ্ধতিতে কাজ দেয়া হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব প্রাধান্য পায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সরকারি বরাদ্দকৃত অর্থের। কিন্তু তেমন কাজ হয় না।
এ প্রসঙ্গে পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, জামালপুরের প্রকল্প দুটি যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় সে সিদ্ধান্তই নেয়া হবে। তিনি বলেন ওটিএম (ওপেন টেন্ডারিং মেথড) পদ্ধতিতে কাজ বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদন হয়েছে। এখন ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করতে হলে সিসিইএর (কেবিনেট কমিটি অন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স) অনুমোদন নিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। আমরা চাই সঠিকভাবে কাজ বাস্তবায়ন হোক।
জামালপুর জেলার ইসলামপুর ও সরিষাবাড়ি উপজেলায় যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেয়া হয় আগস্টে। ইসলামপুরের বেলগাছা ইউনিয়নের কুলকান্দি ও পুঠাইল হার্ড পয়েন্টের মধ্যবর্তী যমুনা নদীর বাম তীর রক্ষা প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮৪ কোটি টাকা। এছাড়া সরিষাবাড়িতে যমুনা নদীর বাম তীর সংরক্ষণের মাধ্যমে ভুয়াপুর তারাকান্দি সড়ক রক্ষায় ২০৩ কোটি ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আগস্টের ৯ তারিখে ৫৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প দুটি একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। এখানে ওটিএম (ওপেন টেন্ডারিং মেথড) পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে প্রকল্পের কাজ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের পছন্দের লোকজনকে কাজ দেয়ার জন্যই এ আয়োজন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, জামালপুরের প্রকল্প দুটি একনেকে অনুমোদনের ৩ মাসের মধ্যে কাজ শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রায় ৪ মাস পার হতে যাচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত দরপত্রই আহ্বান করা হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মাহফুজুর রহমান বুধবার এ প্রসঙ্গে বলেন, জামালপুরের প্রকল্প দুটি এস্টিমেট (প্রাক্কলন) পর্যায়ে আছে। এ বছরই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন ডিপিএম পদ্ধতিতে কাজ দেয়ার কোনো পরিকল্পনার কথা আমার জানা নেই। প্রকল্প অনুমোদনের ৩ মাসের মধ্যে কাজ শুরুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহাপরিচালক কোনো উত্তর দেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ডিপিএম পদ্ধতি অনুসরণে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে একাধিক প্রভাবশালী ঠিকাদার নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে এ পদ্ধতিতে কাজ নেয়ার পাঁয়তারা করে থাকেন। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়। ব্যক্তি বিশেষ কেউ লাভবান হলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, ‘পাউবোর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা প্রকল্প বাস্তবায়নে কড়াকড়ি আরোপ করলে তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়। যে কারণে সঠিকভাবে কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা সম্ভব হয় না। বছরের পর বছর ঝুলতে থাকে প্রকল্পের কাজ। সঠিক অগ্রগতি প্রতিবেদন না দেয়ায় মাসিক এডিপি পর্যালোচনা সভায় সিনিয়র মন্ত্রীসহ সচিবদের তোপের মুখে পড়েন কর্মকর্তারা।’
পাউবোর এ কর্মকর্তার দেয়া তথ্যের মিল পাওয়া যায়, ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে মাসিক এডিপি পর্যালোচনা সভার কার্যবিবরণীতে। ওই দিন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সভাপতিত্বে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার কার্যবিবরণীর এক স্থানে বলা হয়, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২২টি প্রকল্প বাস্তায়নে ডিপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্প নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন।’ সভায় পানিসম্পদমন্ত্রী প্রত্যেক মাসে বর্ণিত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি প্রতিবেদনসহ বিস্তারিত তথ্য মন্ত্রণালয়ে দাখিলের নির্দেশ দেন।
৯ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্প দুটির অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২০ সালের ৩০ জুন। কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকের সভায় বলেন, ‘প্রকল্পের বাস্তবায়নের মেয়াদ কমিয়ে ২ বছরের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। প্রকল্প অনুমোদনের ৩ মাসের মধ্যে কাজ শুরু করতে হবে।’
সভায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘যমুনার দুই তীরের মাটি বেশ নরম। তাই বন্যার সময় ভাঙার প্রবণতা বেশি থাকে। ৩ বছর ধরে কাজ করা হলে একদিকে তীর বাঁধাইয়ের কাজ করতে না করতেই অন্যদিকে ভেঙে যাবে। তাই একসঙ্গে দ্রুত কাজ করতে হবে।’ কাজ বাস্তবায়ন দৃশ্যমান করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) বলেন, ‘প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো প্যাকেজের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করে বিভিন্ন ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কমে আসবে।’ গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য মতামত পেয়ে প্রধানমন্ত্রী ২০১৯ সালের ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।
খবর৭১/জি: