শেখ দীন মাহমুদ,পাইকগাছা(খুলনা) :
জলবায়ু পরিবর্তন সহ নানা প্রতিকূলতায় চলতি মৌসুমে জেলার চিংড়ি ঘেরগুলোতে আশানুরুপ চিংড়ি উৎপাদন নাহলেও চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে খুলনা থেকে ১১শ’ ৮৪ কোটি টাকার হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। গেল অর্থ বছরের একই সময়ে রপ্তানির পরিমান ছিল ১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। একদিকে উৎপাদন হ্রাস অন্যদিকে নভেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে দক্ষিণাঞ্চলের হিমায়িত বাগদা ও গলদার দাম প্রতি পাউন্ডে কমেছে দেড় থেকে দু’ডলার পর্যন্ত।
সূত্র জানায়, অপরিকল্পিতভাবে চাষাবাদের কারণে উন্নত বিশ্বের যে কোন দেশের তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলে বাগদা ও গলদার উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম। এরপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ,কথিত ভাইরাসের সংক্রমণ সহ নানা কারণে প্রায় প্রতি বছরই দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ি খামার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একারণে চাষীদের সিংহভাগই জড়িয়ে পড়ছেন ঋণের জালে। সংশ্লিষ্টদের দাবি,চিংড়ি চাষে পরিকল্পনাহীনতা,সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও অসাধু ব্যবসায়ীরা এজন্য দায়ী। সূত্র জানায়,বছরের এপ্রিলের দাবদাহ ও অতিবৃষ্টির ধকলে চিংড়ি খামারে দেখা দেয় মড়ক। যা প্রতিরোধে এখ নপর্যন্ত সরকারি বা বে-সরকারি পর্যায়ে কোন বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারেনি। মূলত মার্চ-এপ্রিলে তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৬ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করে। আবহাওয়া অফিস চলতি বছরের জুন মাসে ৩৫৬ মিলিমিটার, জুলাই মাসে ৬৮৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। আর সেপ্টেম্বর মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৮ দিনে ২৫ মিলিমিটার বেশি এবং অক্টোবর মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮০ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এছাড়া গেল বছরের ডিসেম্বরের ৩ দিনের মৃদু শৈত্য প্রবাহের সাথে চলতি বছরের জানুয়ারির তিন দিনের শৈত্য প্রবাহ ঘেরের চিংড়িতে বিরুপ প্রভাব ফেলে। শুর হয় মড়ক।
মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ-পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকারের দেওয়া তথ্য মতে,এ বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১১শ’ ৮৪ কোটি টাকা মূল্যের ১১ হাজার ৯৮৭ মেট্রিক টন হিমায়িত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি হয়। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা মূল্যের ১২ হাজার ৭৮২ মেট্রিক টন। জানাযায়,খুলনাঞ্চলের মোট ৪৩টি হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিদেশে চিংড়ি রপ্তানি করছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের ৮৩ শতাংশই রপ্তানি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নে। সূত্র আরও জানায়, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া থাকায় ইতোমধ্যে দু’টি হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে র্যাপিড এ্যালার্ট (সতর্ক বার্তা) দেওয়া হয়েছে।
হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মডার্ণ সী ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজার (বিক্রয়) সাইফুদ্দিন তনু জানান,হিমায়িত পণ্যের সবচেয়ে বেশী অংশ রপ্তানি হয় বেলজিয়াম, জার্মান, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডে। সূত্র আরো জানায়,বাগদার পর চলতি গলদা আহরণ মৌসুমে প্রকারভেদে হিমায়িত দাম নিম্নমুখি। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের তুলনায় বর্তমানে প্রতি পাউন্ডে দাম কমেছে দেড় থেকে দু’ডলার পর্যন্ত। এরপর শুধুমাত্র ইউকেতে গলদা রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে ৭০ শতাংশ। এর জন্য সেখানকার মুদ্রার মাণ নিম্নমুখি হওয়ার পাশাপাশি এদেশের অসাধু ব্যবসায়ীরাই দায়ী। ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যেও বছরের প্রায় সারাটা সময় জুড়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওজন ও গ্রেড ভাল করতে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে থাকে। যা প্রতিরোধে প্রশাসনের পক্ষে মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করলেও প্রয়োজনের তুলনায় যা খুবই অপ্রতুল। এজন্য প্রশাসনের পক্ষে অবশ্য জনবল সংকট থেকে শুরু করে বরাবরই নানা সংকটকে সামনে আনা হয়। চাষীদের দাবি, ঠিক যেখানে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ হয় প্রশাসন সেখানে কখনো অভিযান দেয়না। পুশ প্রথা চালু রাখতে স্থানীয় প্রশাসনের মাসোহারা গ্রহনের অভিযোগও সেই প্রথম থেকে। নানা কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চিংড়ির মূল্য হ্রাস,আমদানিতে অনাগ্রহ,উৎপাদন হ্রাস ও সর্বেপরি রপ্তানি কমেছে। এমনটি চলতে থাকলে সম্ভাবনার মুখে থাকা চিংড়ি শিল্প হারিয়ে যেতে পারে। আর তা যদি হয়,শিল্পটির সাথে জড়িয়ে থাকা লাখ লাখ পরিবার উদ্বাস্তু হতে পারে। এমনটাই আশংকা করছেন চিংড়ির সাথে জড়িতরা।
ন্যাশনাল সী ফুডের প্রতিনিধি জানান, এক পাউন্ড ওজনের ৫ পিস হিমায়িত বাগদা চার মাসে আগে ১৩ ডলার মূল্যে বিক্রি হয়েছে। এখনকার মূল্য ১১ ডলার। এ সত্ত্বেও ন্যাশনাল সী ফুড তিন মাসে ৩০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রসঙ্গত, খুলনা জেলায় চলতি মৌসুমে ২০ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে গলদা এবং ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদার উৎপাদন হয়েছে।খবর ৭১/ ই: