মঈনুল হাসান রতন, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই।
কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই।
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে।
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে।
বাবুই হাসিয়া কহে সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই তবু থাকি নিজের বাসায়।’
এটি রজনীকান্ত সেনের বিখ্যাত ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতার চিরচেনা কয়েকটি লাইন। হবিগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় এক সময় তাল ও খেজুর গাছে বাবুই পাখির বাসা দেখা যেত প্রায়ই। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যাপকভাবে কেটে ফেলা হচ্ছে এসব গাছ। অনেক স্থানে আবার এ গাছগুলো মরে যাচ্ছে। যদিও অন্যান্য গাছ রোপন করা হচ্ছে। তবে সেইভাবে এসব গাছ রোপন করা হচ্ছে না, বললেই চলে। তাই একদিকে এসব গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখিও। কারণ এসব গাছ কমে যাওয়ায়, বাবুই পাখি বাসা তৈরী করে বসবাস করতে পারছে না। তার সাথে আবার একশ্রেণির লোকেরা এ পাখি শিকারও করছে। এর মাঝে আবার, বাবুই পাখি ও এর শৈল্পিক নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য হবিগঞ্জে কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এসব কারণেই বাবুই পাখির চোখ জুড়ানো বাসা এখন আর চোখে পড়ে না। ছোট হলেও বুদ্ধিতে সব পাখিকে হার মানায়।এ ব্যাপারে উদ্ভিদ গবেষক মাহমুদুর রহমান মামুন ও পরিবেশপ্রেমিক বন গবেষক আহমদ আলী বলেন, খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচি পাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তাল ও খেজুর গাছে চমৎকার আকৃতির বাসা তৈরি করত ছোট্ট বুদ্ধিমান বাবুই পাখিরা। ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ ছড়ায়। পেট দিয়ে ঘসে গোল অবয়ব মসৃণ করে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে এক দিকে বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা হয়। অন্য দিকে লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ তৈরি করে বাবুই পাখির বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি মজবুত।মাঝে-মধ্যে নারিকেল গাছের শাখাতেও এরা বাসা বাঁধে। মেধাবী বলেই এরা সুন্দর বাসা বোনে। প্রবল ঝড়ে বাতাসে টিকে থাকে তাদের বাসা। বাবুই পাখির মুক্ত বুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া কঠিন। বাবুই একধারে শিল্পী, স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বন্যপ্রাণী প্রকৃৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা মিহির কুমার দো বলেন, বাবুই পাখি এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায়, পছন্দের সঙ্গী খুঁজতে। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সঙ্গী বানানোর জন্য খালবিল ও ডোবায় গোসল করে ফুর্তিতে নেচে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। এরপর উঁচু তালগাছ, নারিকেল বা সুপারি গাছের ডালে বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই খুবই শিল্পসম্মতভাবে নিপুণ বাসা তৈরি করে।পুরুষ বাবুই পাখি কেবল বাসা তৈরি করে। স্ত্রী বাবুই ডিম দেয়ার সঙ্গেই পুরুষ বাবুই খুঁজতেই থাকে আরেক সঙ্গীকে। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। এরা ঘর-সংসার করতে পারে ছয় সঙ্গীর সঙ্গে, তাতে স্ত্রী বাবুইয়ের বাধা নেই। প্রজনন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফুটে। আর তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা ছেড়ে উড়ে যায়। তিনি বলেন, হবিগঞ্জে বাবুই পাখি রক্ষা করতে আমরা কাজ করছি। তবে নিজ নিজ এলাকায় বা বাড়িতে তাল, খেজুর, সুপারি, নারিকেল গাছ বেশী করে লাগানোর জন্য তিনি সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। জানা গেছে, সারা বিশ্বে বাবুই পাখির প্রজাতির সংখ্যা ১১৭। তবে বাংলাদেশে দেশি বাবুই, দাগি বাবুই, বাংলা বাবুইসহ তিন প্রজাতির বাবুই পাখির বাসা দেখা যায়। বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্য এরা জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে এবং সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। বাবুই খাবারের জন্য রাতের বেলা ঝাঁকবেঁধে নামে আখ ও ধানের জমিতে। এই সুযোগটাই নেয় শিকারিরা। তারা জাল পেতে রাখে। জালে আটকা পড়ে শত শত বাবুই। প্রতিটি পাখি থেকে ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম মাংস পাওয়া যায়। সামান্য লোভের জন্য এভাবেই বাবুই পাখি শিকার চলছে।
খবর ৭১/ইঃ