জনরোষে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ভারতে বসে ষড়যন্ত্র করছেন এমন ইঙ্গিত করে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ষড়যন্ত্র করে কোনো লাভ হবে না। দেশের প্রশ্নে জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ।
ভারতীয় গণমাধ্যমের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ভারতীয় মিডিয়া মিথ্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে করতে চেয়েছিল। কিন্ত এদেশের মানুষ তাদের সে পাতা ফাঁদে পায় দেয়নি। দেশের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সে ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছে।
শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) সকালে কুমিল্লা নগরীর টাউন হল মাঠে মহানগরী জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। কুমিল্লায় প্রায় ১৯ বছর পর জামায়াতের কোনো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মহানগরী জামায়াতের আমির কাজী দ্বীন মোহাম্মদ। মহানগরী নায়েবে আমির অধ্যাপক এ কে এম এমদাদুল হক মামুন ও সেক্রেটারি মাহবুবুর রহমানের যৌথ পরিচালনায় প্রধান বক্তার বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মু. তাহের। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুম, মাওলানা আব্দুল হালিম, চাকসুর সাবেক ভিপি অ্যাডভোকট জসীম উদ্দিন সরকার, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মু. আবদুর রব, মোবারক হোসেন প্রমুখ।
শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করেন মহানগরী মজলিসে শুরা সদস্য ড. আবরার আহম্মদ। সমাবেশের উদ্বোধন করেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ মাছুম মিয়ার পিতা শাহীর মিয়া।
দীর্ঘ ১৯ বছর পর অনুষ্ঠিত সমাবেশ উপলক্ষে গত কয়েক দিন ধরে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায় জামায়াত। দলীয় আমিরকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন ও তোরণ দিয়ে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় পুরো নগরী। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় সম্মেলন শুরুর কথা থাকলেও সকাল সাড়ে ৬টা থেকেই নগরীর ২৭টি ওয়ার্ড ও ৬টি ইউনিয়ন থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সম্মেলনে যোগ দেন নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে পুরুষদের জন্য টাউন হল মাঠ ও নারীদের জন্য নির্ধারিত কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
এক পর্যায়ে কর্মী সমাবেশ জনসমাবেশে রূপ নেয়। পুরুষদের প্যান্ডেল টাউন হল মাঠের আশপাশের এলাকা পূবালী চত্বর, লিবার্টি মোড়, জিলা স্কুলের সামনের রাস্তা, মনোহরপুর, বাদুড়তলা ও লাকসাম রোডের পুরো রাস্তাই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। অপরদিকে নারীদের জন্য নির্ধারিত ঈদগাহ মাঠেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় সিটি পার্ক মোড় ও প্রেস ক্লাবসহ আশাপাশের এলাকাও নারী কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
‘সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দিতে হবে’
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, প্রশাসনের সর্বস্তরে সংস্কারের জন্য আমরা সরকারকে সময় দিয়েছি। প্রয়োজনে আরও দেব। তবে মৌলিক সংস্কার করে যৌক্তিক সময় নির্বাচন দিতে হবে। ২০২৪ সালের জুলাই গণহত্যার বিচার করতে হবে। তবে আমরা আইন হাতে তুলে নিতে চাই না। পরাজিত শক্তি এখনো বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
জামায়াত আমির বলেন, আমরা কাউকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করতে চাই না। সবার পরিচয় হবে আমরা বাংলাদেশি।
কুমিল্লা নামে বিভাগ না দেওয়ায় বিগত সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, নামের কারণে বিভাগ না দিয়ে একটি জেলার মানুষের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। দেশের এক ইঞ্চি মাটির প্রতি অবজ্ঞাকারী কোনো ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা নেই। তিনি কুমিল্লা নামে বিভাগ বাস্তবায়নের দাবি জানান। এছাড়া কুমিল্লা বিমানবন্দর সচলের যৌক্তিকতাও তুলে ধরেন তিনি।
জামায়াত আমির বলেন, গত সাড়ে ষোল বছর আদালত আঙ্গিনা ছিল বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের দখলে। মূলত পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের অস্তিত্ব ধ্বংস করার মিশন শুরু হয়। এরপর ধাপে ধাপে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। বিশেষ করে জামায়াতের ওপর সবচেয়ে বেশি অবিচার করা হয়। আমাদের শীর্ষ নেতাদের একে একে মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়। অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাকে কারাগারে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। আমাদের কার্যালয়গুলো অন্যায়ভাবে বন্ধ রাখা হয়। তবে এত নির্যাতনের পরও আল্লাহর রহমত ও নেতাকর্মীদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা টিকে আছি।
তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর দাবি জানান। বাস্তভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নের দাবি জানান। বলেন, বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে নিজস্ব অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেলে নারীরা যথাযথ মর্যাদা ও নিরাপত্তা পাবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। বলেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে সবাইকে মূল্যায়ন করা হবে। তিনি অভিযোগ করেন, বিগত দিনে পুলিশের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তারপরও আমরা প্রতিশোধপরায়ন হইনি। আমরা সবাই মিলে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই।
গণমাধ্যম কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, সব সময় সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে হবে। অন্যায়কারী যেই হোক কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। অন্যায়কারী হলে আমার বিরুদ্ধেও লিখবেন।
জামায়াত আমির বলেন, চব্বিশের আন্দোলনের মূল সেনাপতি ছিলেন শিক্ষার্থীরা। আমরা শুধু তাদের পাশে থেকে পানি পান করিয়েছি। নেতাকর্মীদের চরিত্র গঠনের পাশাপাশি মানুষের যেকোনো ক্রান্তিকালে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন জামায়াতের আমির।
কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা.সৈয়দ আবদুল্লাহ মু. তাহের বলেন, ভারত আমাদের প্রতি আগ্রাসী আচরণ করলে বাংলাদেশের মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবেলা করবে। সীমান্তে শহীদের মিছিল হবে। তারপরও আধিপত্যবাদী শক্তিকে মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। আগামী নির্বাচনে সৎ ও খোদাভীরু নেতা নির্বাচিত করতে হবে। ডা. তাহের কুমিল্লা নামে বিভাগ ঘোষণা ও কুমিল্লা বিমানবন্দর সচলের দাবি জানান।
সম্মেলনে আরও বক্তব্য কেন্দ্রীয় শূরা ও অঞ্চল টিম সদস্য অধ্যাপক লিয়াকত ভূঞা, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও টিম সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আমির অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শাহজাহান, কুমিল্লা উত্তর জেলা আমির অধ্যাপক আবদুল মতিন, শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ইয়াসির আরাফাত, ড. মোবারক হোসেন, কুমিল্লা মহানগরী নায়েবে আমির মোছলেহ উদ্দিন, দক্ষিণ জেলা সেক্রেটারি ড. সৈয়দ সরোয়ার উদ্দিন সিদ্দিকী, কুমিল্লা উত্তর জেলা সেক্রেটারি সাইফুল ইসলাম শহীদ, মহানগরী সহকারী সদস্য কামারুজ্জামান সোহেল, মহানগরী শিবির সভাপতি নোমান হোসেন নয়ন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি হাফেজ ইউসুফ ইসলাহী, মহানগরী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মোশাররফ হোসেন, নাছির আহমেদ মোল্লা প্রমুখ।