গেট খুলে দেওয়ায় ভারতের ত্রিপুরার পানিতে যখন হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি জেলা তখন নতুন দুঃসংবাদ দেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য। এবার ফারাক্কা ব্যারেজের সব গেট খুলে দিয়েছে প্রতিবেশী ভারত। এসব গেট দিয়ে এক দিনে বাংলাদেশে ১১ লাখ কিউসেক পানি প্রবাহিত হবে, যা দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. ময়েজ উদ্দিন বলেন, ‘গতকাল পর্যন্ত ২৭টি গেট খোলা ছিল, কিন্তু আজ ১০৯টি গেট খুলে দেওয়ার খবর পেয়েছি। এতগুলো গেট খুলে দেওয়ায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।’
নদী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভারাইন পিপলের পরিচালক এম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ফারাক্কার গেট খুলে দেওয়ার খবরটি আমাদের জন্য বিপজ্জনক। এর ফলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলো প্লাবিত হতে পারে।’
ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বন্যা পরিস্থিতি ও পাহাড়ি ঢলের তথ্য বাংলাদেশকে আগে থেকেই দেওয়া হয়েছে। ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে বন্যার কারণে পানির চাপ বেড়েছে। যদিও নেপাল থেকে এখনও পাহাড়ি ঢল আসেনি, যা কিছুটা স্বস্তির বিষয়। বর্তমানে ফারাক্কা ব্যারেজের পানি বিপৎসীমার ৭৭ দশমিক ৩৪ মিটার ওপর দিয়ে বইছে, তাই গেটগুলো খুলতে বাধ্য হয়েছেন। ফিডার ক্যানেলেও পানি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ফারাক্কা ব্যারেজের জেনারেল ম্যানেজার আর দেশ পাণ্ডে বলেন, ‘ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ সবসময় সতর্ক থাকে এবং নিয়মিত নজর রাখছে। পানির চাপ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার কারণে ১০৯টি গেট খুলতে না দিলে বড় ক্ষতি হতে পারত। বর্তমানে ফিডার ক্যানেলে ৪০ হাজার কিউসেক ও ডাউনস্ট্রিমে ১১ লাখ কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, এই পানি ছাড়ার ফলে ফারাক্কার আশপাশের গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
ফারাক্কা ব্যারেজের আপ স্ট্রিমে পানির ধারণ ক্ষমতা ২৬.২৪ মিটার, বিপৎসীমা ২২.২৫ মিটার এবং সতর্কতা সীমা ২১.২৫ মিটার। আপ স্ট্রিমের পানি ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম করায় শনিবার থেকে অধিকাংশ গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ব্যারেজ থেকে ১১ লাখ কিউসেকের বেশি পানি ছাড়ানো হচ্ছে।
এদিকে, কুশিয়ারা, গোমতি ও মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। সোমবার (২৬ আগস্ট) সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশের তিনটি নদীর তিন স্টেশনের পানি বিপৎসীমার ওপরে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ৪ নদীর ৬টি স্টেশনের পানি বিপৎসীমার ওপরে ছিল। এর মধ্যে গোমতির নদীর কুমিল্লা স্টেশনের পানি ৭৮ সেন্টিমিটার থেকে নেমে আজ ৪৫ সেন্টিমিটার ওপরে বইছে। মুহুরী নদীর পরশুরাম স্টেশনের পানি আজও বিপৎসীমার ওপরে আছে, তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় পানির উচ্চতা সম্পর্কে জানা যায়নি। রোববার (২৫ আগস্ট) কুশিয়ারা নদীর পানি তিন স্টেশনে বিপৎসীমার ওপরে থাকলেও আজ শুধু অমলশীদ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপরে বইছে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের পূর্বাঞ্চল ও উজানে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় কুমিল্লা জেলার গোমতী নদীর পানি কমতে পারে এবং আশপাশের নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ফেনী জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিরও উন্নতি হতে পারে, তবে কিছু স্থানে পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উজানে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময়ে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার প্রধান নদীগুলোর পানি বাড়তে পারে।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি কমছে, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে এবং উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রয়েছে। এসব পরিস্থিতি আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে যশোরে, ২২২ মিলিমিটার। এছাড়া বরগুনায় ১২০, বরিশালে ১০৪, টেকনাফে ১০১, পটুয়াখালীতে ৮৮, নোয়াখালীতে ৮৭, গোপালগঞ্জের হরিদাশপুরে ৮৫, কক্সবাজারে ৮২ এবং বান্দরবানের লামায় ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বন্যা চলছে। ভারত থেকে আসা পানি ও অতিবৃষ্টির কারণে এসব জেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত এসব জেলায় বন্যায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আরও দুইজন নিখোঁজ রয়েছেন। মৃতদের মধ্যে কুমিল্লায় ছয়জন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে পাঁচজন, খাগড়ছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে পাঁচজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন ও কক্সবাজারে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া, এই বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫৫ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।