পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে শহীদ হওয়া এই তরুণের সাহস আর প্রতিবাদী ক্ষোভ ধারণ করে বিজয় এসেছে ছাত্র-জনতার। সাঈদের পর আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন আরও কয়েকশ’ ছাত্র-জনতা। তাদের আত্মত্যাগের পথ ধরে গঠিত হয়েছে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। দায়িত্ব নেয়ার পর আনুষ্ঠানিক অফিস শুরুর আগেই প্রথম রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি সাঈদের বাবা-মা’সহ পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেয়ার সময় আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। সাঈদের কবর জিয়ারত ও মোনাজাতের পর সেখানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন ড. ইউনূস। যে পতাকা হাতে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন সেই পতাকা তুলে দেন আবু সাঈদের বাবার হাতে।
প্রায় আধাঘণ্টা আলাপচারিতায় আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন, আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী, আবু হোসেনসহ পরিবারের সদস্যরা ৮ দফা দাবি সংবলিত একটি আবেদন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেন। এতে আবু সাঈদসহ ছাত্র-জনতার হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা, আবু সাঈদের স্মরণে ১৬ই জুলাইকে শহীদ আবু সাঈদ দিবস ঘোষণা করা, আবু সাঈদের স্মরণে পীরগঞ্জে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, একটি পাবলিক গ্রন্থাগার, স্মৃতি সংরক্ষণাগার, একটি মসজিদ ও এতিমখানা নির্মাণ, আবু সাঈদের নামে তার নিজস্ব এলাকায় বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় শহীদি মর্যাদায় ভূষিত করা এবং অষ্টম বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে ঘোষণা করা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পটভূমি মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, তরুণদের জন্য একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ, জাফরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আবু সাঈদের সমাধিস্থল সংলগ্ন রাস্তাটি জাফরপাড়া মাদ্রাসা পর্যন্ত প্রশস্তকরণের দাবি জানানো হয়।
এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সকলকে ঐক্যবদ্ধ করাই বর্তমান সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। নতুন স্বাধীনতা দিতে আবু সাঈদ যে স্বপ্নের জন্য বুক পেতে দিয়েছিল, আমাদের কাজ হলো- সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা।
এটা গোটা জাতির কর্তব্য। আমি শুধু এখানে এসে কবর জিয়ারত করলাম, চলে গেলাম তা- না। এটা সারা জাতিকে বলতে চাই। যে লক্ষ্য নিয়ে বুক পেতে দিয়েছিল, যার কারণে কোটি কোটি ছেলে-মেয়ে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ভয় পায় নাই। আবু সাঈদের জন্য আমরা যে নতুন বাংলাদেশ পেলাম, সেটি গড়ার দায়িত্ব আমাদের। তার কথা স্মরণ হবে- এই কাজ করার মধ্য দিয়ে।
তিনি বলেন, জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে অতি দ্রুতই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, একটি মুক্তির জন্য আবু সাঈদ বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছবি দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একটা মানুষ বন্দুকের সামনে হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে বলছে- মারেন। গুলি করেছে, একটু হেলে উঠে আবার দাঁড়িয়েছে। পরে আবার একটা গুলি করেছে। আবু সাঈদ এখন পীরগঞ্জের না, তিনি এখন সারা বিশ্বের। আবু সাঈদ যে কাজ করেছে এটি নিয়ে যুগ-যুগান্তর কবিতা হবে, উপন্যাস হবে, নাটক হবে। মানুষ তাকে সারা জীবন স্মরণ করবে। এই সেই লোক এখানে শুয়ে আছে। তিনি বলেন, যারা ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে বড় হবে, স্কুলে আবু সাঈদের কথা পড়বে। নিজে নিজে প্রস্তুত হবে। আমিও ন্যায়ের জন্য লড়বো, আমিও বুক পেতে দিবো। আবু সাঈদ এখন ঘরে ঘরে। প্রত্যেক ঘরে আবু সাঈদ রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এ মাটির সন্তান। এটা আবু সাঈদের বাংলাদেশ। এটা এক বাংলাদেশ, দুই বাংলাদেশ না। দেশ নিয়ে পার্থক্যকারীদের বিরুদ্ধে আমরা আবু সাঈদের মতো রুখে দাঁড়াবো। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। তার মর্মস্পর্শী বক্তব্যের সময়ে সকলের চোখে অশ্রু চলে আসে। এ সময় আবেগতাড়িত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আন্দোলন সমন্বয়কারী ও অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদসহ অন্যরা। এরপর তিনি আবু সাঈদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন ও রংপুরের সমন্বয়কারীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোটা আন্দোলনে আহতদের দেখতে যান।
বিকালে রংপুর সার্কিট হাউজে প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে ক্রয়ক্ষমতার আওতায় আনাই লক্ষ্য উল্লেখ করে সকলের সহযোগিতা চান।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নিরাপরাধীদের কোনো হয়রানি নয়। তাদেরকে ফুলের টোকাও দেয়া হবে না। আমরা অপরাধীদের বিচার করবো। দেশে সহিংসতা বন্ধ হলে ১৭ কোটি মানুষকে আরও বহু উপরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, দেখা যাবে কতোদিনে ভালো হয়। এখন আপনারাই বিচার করেন কতোদিন হলে ভালো হবে। এটা তো কেউ এখনো বলে নাই।
তিনি আরও বলেন, আমরা সবাই একটি পরিবার, সবাইকে উপরে উঠানোর চেষ্টা করবো। এখানে কেউ আমাদের বিদেশি আক্রমণকারী নেই, আমরা-আমরাই। একটি পরিবারে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হতে পারে, তাই বলে সম্পর্ক নষ্ট হয় না। আমরা একটি পরিবার হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চাই।
এর আগে বেলা আড়াইটায় রংপুর সার্কিট হাউজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি।
দুপুর পৌনে ২টায় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্ববিদ্যায়ের প্রশাসনিক ভবন মিলনায়তনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। সেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের নানা দাবিসহ আগামীর বাংলাদেশ গড়তে তাদের প্রত্যাশার কথা শোনেন। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, নতুন বাংলাদেশ তরুণদের বাংলাদেশ। তরুণদের এখন কেউ টেনে রাখতে পারবে না। পথ পরিষ্কার করতে হবে। বেগম রোকেয়া নারীদের মুক্ত করেছেন। এখন রংপুর পুরো বাংলাদেশকে মুক্ত করবে।
এর আগে সকাল ১১টায় তিনি হেলিকপ্টারে করে রংপুর পীরগঞ্জের মেরিন একাডেমিতে আসেন। এরপর সড়ক পথে উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের জাফরপুর বাবনপাড়া গ্রামে কোটা আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদের বাড়িতে যান। সেখানে তার কবর জিয়ারতসহ পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন, ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলমসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।