দেশে তামাকজাত পণ্যে আসক্ত প্রায় ৩৫ শতাংশ

0
101

দেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৩৫ জন তামাকজাত পণ্যে আসক্ত। তামাক পণ্য গ্রহণকারীরে মধ্যে প্রায় অর্ধেক তরুণ প্রজন্ম। এদের দীর্ঘমেয়াদি তামাক সেবনের কারনে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ক্যানসারসহ অন্যান্য ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এমনকি ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ এবং শরীরের অন্যান্য ক্যানসারের জন্য ৫০ শতাংশরে জন্য দায়ী এ তামাক।

এদিকে আজ সারা বিশ্বের শতো বাংলাদেশে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হবে। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’। প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যানসার হাসপাতাল প্রকল্প, গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল ও প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) অন্যান্য সংগঠনের উদ্যোগে আলোচনা সভা ও প্রতীকী শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশই তরুণ-তরুণী, তাদের অর্ধেকে সিগারেসহ অন্যান্য তামাক পণ্য নিয়ে থাকে। একটা সময় তরুণরা ধূমপান করত। এখন তরুণীরাও ধূমপায়ী হচ্ছে। রাজধানীর  ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্য পাবলিক প্লেসে উন্মুক্তভাবে তরুণ-তরুণীরা সিগারেট টানছে। কিছু দিন আগেও এমন প্রকাশ্যে মেয়েরা ধূমপান করেনি। আসক্তির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছে। তবে সামনের দিনগুলোতে এ অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে।

তারা বলেন, দেশে তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যায় তামাকজনিত রোগে। বর্তমানে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ লাখ মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত। এছাড়া ৬২ থেকে ৭০ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানে নানা রোগব্যাধিতে ভুগছেন। এমনকি প্রতি বছর ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে এই তামাক পণ্য সেবনে।

গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যানসার হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ও প্রিভেন্টিভ অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন. যেসব তরুণী ধূমপান করেন তাদের প্রথম সমস্যা শুরু হবে বিয়ের পর প্রসবকালীন সময়ে। তাদের গর্ভের সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস হয়ে গেলে প্রসবের সময় একলামসিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। শিশু সন্তান অটিজমেও আক্রান্ত হতে পারেন।

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, অল্প বয়সে ধূমপান শুরু করলে সারা জীবনই ধূমপান করতে হয়। সেক্ষেত্রে ধূমপায়ীর আয়ুু কমে যায়। ৫০ শতাংশ ধূমপায়ীদের নানা ধরনের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমনকি দেশে যেসব মানুষের ফুসফুসে ক্যানসার হয় তাদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ নারী-পুরুষের তামাকপণ্য সেবনের ইতিহাস রয়েছে।

গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, তামাকই পৃথিবীর একমাত্র বৈধ পণ্য। যা তার ভোক্তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তামাকসেবী যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে কিংবা রোগব্যাধির প্রকোপে তামাক সেবন ছাড়তে বাধ্য হয়। এমনকি দেশেই তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যুর কারণে তামাক কোম্পানিগুলোকে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার ভোক্তা হারাচ্ছে। তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই তামাক কোম্পানিগুলো নতুন প্রজন্মকে ফাঁদে ফেলে কিশোর-কিশোরী হাতে তামাকপণ্য তুলে নিচ্ছে। দেশে বর্তমান মোট জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশই তরুণ-তরুণী এবং এরাই কোম্পানির মূল টার্গেট।

টোব্যাকো অ্যাটলাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩৫ দশকিম ৩ শতাংশ। এদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ পুরুষ ও মহিলা ২৫ দশমিক ২ শতাংশ। ১৮ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন ২০ দশকিম ৬ শতংশ মানুষ। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সিদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর হার ৬ শতাংশ। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ।

দেশে প্রতিদিন কর্মক্ষেত্র পাবলিক প্লেস ও পরিবহণে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৩ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ। প্রাপ্তবয়স্কদের ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্রে, রেস্তোরাঁয় ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পাবলিক প্লেসে ৪৪ শতাংশ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সি অন্তত ৩ কোটি ৭০ লাখ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত তামাক ব্যবহার করে। এই কিশোর-কিশোরী পরবর্তী সময়ে তামাকের নিয়মিত ভোক্তা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের (সিডিসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২১ বছর বয়সের আগেই যারা তামাকে আসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের মধ্যে নিকোটিন নির্ভরতা এবং আমৃত্যু তামাক ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই প্রজন্মকে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডে আকৃষ্ট করতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করে তামাক কোম্পানিগুলো। ২০১৭ সালে আমেরিকায় ই-সিগারেটর বিজ্ঞাপনে মোট ব্যয় হয় ৪৮ মিলিয়ন ডলার, যা এক বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে বেড়ে ১১০ মিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়ে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় অঞ্চলে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অথচ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যা ২ শতাংশ।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিপার্টমেন্ট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে চাইলে আমাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এই আইনগুলো বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, বাংলাদেশে তামাকবিরোধী আন্দোলনের শুরুর দিকে প্রথিতযশা কয়েকজন চিকিৎসক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে চিকিৎসকদের অংশগ্রহণ অতি নগণ্য। ফলে স্বাস্থ্যের ওপর তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে ধূমপান ত্যাগ ও এর গ্রহণে বিরত থাকার জন্য জনসচেতনতা কার্যক্রম অবহেলিত হচ্ছে। আমরা তামাকের ওপর কর বৃদ্ধি ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কার্যকর প্রয়োগ চাই। সঙ্গে স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপর যথাযথ গুরুত্ব দেখতে চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here