খবর৭১ঃ
দেশে সাধারণত জুন মাস থেকে ডেঙ্গি জ্বরের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এবার মে মাসেই সর্বাধিক ডেঙ্গি রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ অবস্থায় কারো জ্বর হলেই দ্রুত এনএস-১ পরীক্ষা এবং বাড়তি সতর্কতা জরুরি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গি আক্রান্তের প্লাটিলেটের প্রয়োজন হয় না।
শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শহীদ ডা. মিলন হলে আয়োজিত ‘চেঞ্জিং প্যাটার্ন অফ ডেঙ্গি সিনড্রম’’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন।
সেমিনারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগ প্রতিরোধে এডিস মশার নিধন, ডেঙ্গি জ্বরের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গাইডলাইন অনুসরণের পরামর্শ দেন। রোগ ও রোগীর অবস্থাভেদে চিকিৎসার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের ডেঙ্গি চিকিৎসার জাতীয় নীতিমালার প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক ডা. কাজী তারিকুল ইসলাম। সেমিনার শেষে কেবিন ব্লকের সাধারণ জরুরি বিভাগে ডেঙ্গি কর্নারের উদ্বোধন করা হয়।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গির প্রথম প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ২০০০ সালে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গির সাধারণ উপসর্গ ছিল জ্বর, কাশি, র্যাশ হওয়া, মাথা ব্যথা হওয়া। কিন্তু ২০২১ সালের পর এই উপসর্গ পরিবর্তন হয়। তখন ডেঙ্গিতে নতুন উপসর্গ পেটে ব্যথা ও পাতলা পায়খানাসহ অন্যান্য পরিবর্তন হয়। এটি এখনো চলমান রয়েছে।
সেমিনারে জানানো হয়, ২০২২ সালে ডেঙ্গি আক্রান্ত হন ৬১ হাজার ৭৬৩ জন এবং ২৮১ জন মারা যান। যা অতীতের তুলনায় সর্বাধিক। চলতি বছরের ২ জুন পর্যন্ত আক্রান্ত ১৭৯৩ জন এবং মারা যান ১৩ জন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৫৫৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন ও মে-তে ৭৮৫ জন মানুষ ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ডা. কাজী তারিকুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গি জ্বর ধরা পড়লে পর্যাপ্ত পানি জাতীয় খাবার এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। অযাচিত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন থেকে বিরত থাকবেন। এ সময়ে অ্যাসপিরিন জাতীয় ও ব্যথার ওষুধ বন্ধ রাখতে হবে। বমি, পাতলা পায়খানা, পেট ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শরীরের কোথাও রক্তপাত হলে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
ডা. কাজী তারিকুল বলেন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্লাটিলেট অথবা রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন নাই। ডেঙ্গি জ্বরের ক্ষেত্রে প্রতিরোধই উত্তম। সেজন্যে মশারি ব্যবহার, বাচ্চাদের ফুল হাতা জামা পড়ানো, বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সাধারণ জনগণের সচেতন হতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, একটি গান আছে, ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়, সাদা সাদা ফোটা দেখে এডিস মশা চেনা যায়। এই মশা চিনতে হবে। এই মশাই ডেঙ্গুর জন্য দায়ী। নতুন বিল্ডিং তৈরি করার সময়, উন্নয়নমূলক কাজ করার সময় এবং বৃষ্টির পরে ছাদে পানি জমে থাকে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এক্ষেত্রে দায়ীদের জরিমানা করা যেতে পারে। বাড়ির পেছন পরিষ্কার রাখতে হবে। খালি পাত্র থাকলে তা উল্টো করে রাখতে হবে যেন পাত্রের ভেতরে পানি জমে না যায়। শরীরে ফুল হাতা শার্ট ও পায়ে মোজার ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে।
ডা. শারফুদ্দিন বলেন, ডেঙ্গি হয়েছে কিনা- তা জানতে জ্বর হলে শুরুতেই এনএস ওয়ান টেস্টটি করে নিতে হবে এবং জ্বর হলেই এ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ফলমূলসহ পানি জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। ডেঙ্গি প্রথমবার হলে মৃত্যু হার কম কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার হলে মৃত্যুহার বেশি। যারা ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তাদেরকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, জ্বর হলে প্রয়োজন ছাড়া অযথা বাড়তি টেস্ট এবং বার বার টেস্ট যেন না দেওয়া হয়। ডেঙ্গি জ্বরের কারণে প্লাটিলেট কমে গেলেই রক্ত দিতে হবে, এই ধারণা ভুল। আবার রক্ত দেওয়া যাবেই না, এটাও ঠিক না। রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিবেন- রোগীকে কী কী চিকিৎসা দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ডেঙ্গি ও করোনায় একই উপসর্গ দেখা দেয়। উভয় রোগেই জ্বর, সর্দি ও কাশির লক্ষণ দেখা যায়। এজন্য জ্বর হলেই ডেঙ্গি ও কোভিড পরীক্ষা করাতে হবে।
বর্তমানে পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীও অনেক পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য জ্বর হলেই প্রথম দিনেই এনএস ওয়ান টেস্টটি করাতে হবে। শুরুতে রোগ চিহ্নিত না হলে রোগীর অবস্থার অবনতি হলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
সেমিনারে প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য রাখেন- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. টিটু মিয়া, অধ্যাপক ডা. এমএ জলিল চৌধুরী, বিএসএমএমইউর ইন্টারন্যাশনাল মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেছা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ডেঙ্গি গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার প্রমুখ।