দলীয় কোন্দলে আ. লীগে বেড়েছে খুন

0
196

খবর ৭১: কিছুদিন আগে ইউপি নির্বাচনে পরাজিত হন লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কাশেম জিহাদি। পরাজয়ের কারণে তিনি দলের একটি অংশের ওপর ক্ষুব্ধ হন। অভিযোগ করা হয়েছে, তাঁর এ ক্ষোভের শিকার হন লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম। গত ২৫ এপ্রিল রাতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার বশিকপুর ইউনিয়নের পোদ্দারবাজারে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন।

লক্ষ্মীপুরের মতো দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রতিপক্ষের প্রতি সহিংস হয়ে উঠছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার মধ্যে যেন অশান্ত হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তৃণমূল। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সম্প্রতি বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে দল ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব।

গ্রাফরাজনৈতিক সহিংসতায় বছরের প্রথম তিন মাসে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের যত মানুষের প্রাণ গেছে তার চেয়ে গেল এপ্রিল মাসে বেশিসংখ্যক হত্যার শিকার হয়েছে। চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে খুন হয়েছেন এক আওয়ামী লীগ নেতা।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একাধিক বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলটির মধ্যে একাধিক রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ছয়জন। আর গত এপ্রিল মাসে নিহত হয়েছেন আটজন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবি পেলে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ফলে ব্যক্তিস্বার্থের লোভে অনেকে নিজ দলের নেতাকর্মীকে হত্যা করতেও পিছপা হয় না। নির্বাচনের আগে আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, নির্বাচনী মাঠে দৃশ্যমান শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকায় কিছু কিছু স্থানে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অরাজনৈতিক আচরণ করছেন। ফলে কোথাও কোথাও সংকট ঘনীভূত হয়েছে। কেন্দ্র তীক্ষ নজরদারি করছে যেন দলে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার সুযোগে পেশিশক্তির উদ্ভব না হয়। দল কঠোরভাবে যেকোনো ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করবে।

দেশের কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এতে দেখা গেছে, ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ১০২টি। এতে নিহত হয়েছেন ছয়জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার ৩৭৪ জন। সহিংসতাগুলোর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ।

আসকের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে নিহত ছয়জনের মধ্যে দুজন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী সহিংসতায় মারা গেছেন। বাকি চারজনের মধ্যে তিনজন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ও একজন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে নিহত হন।

তিন মাসে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ হয় ৩১টি। এতে ৩৬৯ জন আহত ও তিনজন নিহত হন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুবলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয় একটি। এতে ১১ জন আহত হন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয় একটি। এতে দুজন আহত হন। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ হয় আটটি। এতে একজন নিহত ও ৫৮ জন আহত হয়েছেন।

গত ৩০ এপ্রিল মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) এক প্রতিবেদন বলা হয়, এপ্রিল মাসে বিভিন্ন জেলায় রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতার ৪০টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৬৯ জন। নির্বাচনী, রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা-সমাবেশে বাধার ঘটনায় মোট ৪৬১ জন আহত ও আটজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিনজন ক্ষমতাসীন দলের, একজন মুদি দোকানদার, একজন টাইলস শ্রমিক, একজন বিএনপিকর্মী এবং দুজন সাধারণ নাগরিক। আহতদের মধ্যে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবি পাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা থাকে। পদ পেলে অগাধ সম্পদশালী হওয়ার-সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ খুনের ঘটনা বাড়ছে।

শুধু দলীয় কোন্দল নয়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সার্বিক রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়বে বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সাধারণত সহিংসতা বাড়ে। এবারের জাতীয় নির্বাচনের আগে তা ব্যাপক আকার নিতে পারে। দুই পক্ষই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করবে ক্ষমতার জন্য। ক্ষমতাসীন দলের জন্য ক্ষমতায় থাকা, আর বিরোধীদের ক্ষমতায় যাওয়া এ দুটোই বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মে মাসের প্রথম সপ্তাহেও ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা খুন হয়েছেন। গত ২ মে বরগুনা সদর উপজেলার পাতাকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম পনুকে প্রতিপক্ষের লোকেরা কুপিয়ে হত্যা করে।

গত এপ্রিলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা খুন হন। গত ৩০ এপ্রিল রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, তিতাস উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম ওরফে সোহেল শিকদার তাঁর অনুসারীদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।

গত ২৫ এপ্রিল রাতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম। নোমান লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে একটি সম্পাদক পদে ছিলেন।

হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে নোমানের বড় ভাই লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কাশেম জিহাদি ইউপি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ঘটনা ও পূর্বশত্রুতার জের ধরে আমার ভাইকে হত্যা করেছে।’

এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কাশেম জিহাদির অনুসারী রামগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দেওয়ান ফয়সাল এরই মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়া অন্য আসামিরাও আওয়ামী লীগ, যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।

গত ২৪ এপ্রিল রাতে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার খানসামারহাট আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সোনা মিয়া (৪৫) নামে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক কর্মী মারা যান। এর আগের দিন গত ২৩ এপ্রিল রাতে রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ সুমন সবুজ নিজ বাড়িতে অবস্থানকালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। এলাকায় ব্যাবসায়িক আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গত ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার উদয়ন মোড়ে জেলা যুবলীগের সাবেক শ্রমবিষয়ক সহসম্পাদক ও শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেসবাউল হক টুটুল ও তাঁর কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, দল থেকে কোথাও কোনো অপকর্ম প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না। কেউ যদি উত্তেজনার বশে কোনো কাণ্ড করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আমরা দলীয়ভাবে কোনো প্রভাবিত করছি না।

অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে মতিয়া চৌধুরী বলেন, এসব অপরাধ কখনো সরল রৈখিক চলে না। কখনো বাড়ে কখনো কমে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here