অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল প্রয়োগ ডেঙ্গির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে জাহিদ হাসান

0
133

খবর৭১ঃ
সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গিতে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৩৪ জন। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গি ভাইরাসের চারটি ধরনই দেশে সক্রিয়। এসব ধরনের সংক্রমণের কারণে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় আতঙ্কিত স্বাজনরা জ্বর বাড়লেই দ্রুত আরোগ্যের জন্য রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন। অনেক সময় রোগী নিজেও কাছের ফার্মেসির লোকজনের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন। এতে ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়ছেন এ ধরনের রোগী। এ ছাড়া জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা রোগীর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এটা অধিকাংশই জানেন না। ফলে তারা স্বাভাবিক চলাফেরা শুরু করেন। এই ভুলের কারণে অনেক সময় রোগী মারাও যাচ্ছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গিজ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা রোগীর জন্য খারাপ সময়। এ সময় রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ হওয়া এমনকি রোগীর শক সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। শক সিনড্রোমের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, নিউমোনিয়া, হার্ট, লাং, অ্যাজমা, ওজনাধিক্য, ডায়াবেটিস ও শরীরে কোলেস্টেরেল বেশি থাকলে অনেক রোগী মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ফলে রোগ শনাক্ত ও ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ সেবনে সতর্ক হতে হবে। তবে ডেঙ্গির সঙ্গে সেকেন্ডারি ইনফেকশন অর্থাৎ কোমরবডিটি বা মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেট্রি হয়। এতে পরিস্থিতি জটিল হয়। তখন চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও জ্বর হওয়ার ৭২ ঘণ্টার আগে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া একেবারেই অনুচিত। কিন্তু অনেক চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, অভিভাবকরা রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে উদ্বুদ্ধ করেন। এছাড়া করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর কেউ ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করলে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা সাধারণ জ্বরেও ডেঙ্গি এবং করোনা পরীক্ষার পরামর্শ দেন। ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে বলছেন।

electromart-300×250
এ প্রসঙ্গে ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গি ভাইরাসের চারটি স্ট্রেইন তথা ডেন- ১, ২, ৩ ও ৪ নামে ধরন শনাক্ত হয়েছে। চারটি ধরনেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষায় তা ধরা পড়ছে। যেকোনো একটি ধরনে কেউ আক্রান্তের পর সুস্থ হলে তার অন্যান্য রোগের ঝুঁকি তৈরি হয়। ডেঙ্গি আক্রান্ত হলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে অন্য রোগ সহজেই কাবু করে ফেলছে।

তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থতা ছাড়া বেশির ভাগ ডেঙ্গি রোগীর উপসর্গ থাকে না বা হালকা লক্ষণ দেখা যায়। সংক্রমিত মশা কামড়ের ৪ থেকে ১০ দিনের পর সাধারণত ২ থেকে ৭ দিন ধরে লক্ষণগুলো স্থায়ী হয়। ফলে প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রচুর তরল খাবার ও জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ খেতে হয়। কোনোভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক, এসপিরিন, আইবুপ্রুফেন বা এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা উচিত নয়।

গত ৩ অক্টোবর জ্বরে আক্রান্ত হন মিরপুর বাংলা কলেজের শিক্ষার্থী তুষার আহমেদ (২০)। আক্রান্তের পর ফার্মেসি থেকে একাধিক ওষুধ কিনে খাওয়ার পরও উন্নতি হচ্ছিল না। ৫ অক্টোবর হঠৎ দাঁতের গোড়া ও পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসতে থাকে। সঙ্গে তীব্র জ্বর, পেট ও মাথাব্যথা ছিল। উপায় না পেয়ে অভিভাবকেরা ৬ অক্টোবর বেসরকারি ডেল্টা মেডিকেলে নিয়ে যার। চিকিৎসকরা তার এনএস-১ পরীক্ষা করে ডেঙ্গির কথা জানান।

শনিবার তুষারের চাচা শামিম আহমেদ যুগান্তর বলেন, ভর্তির পরই নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নেওয়া হয়। ততক্ষণে রক্তের প্লাটিলেট ৭ হাজারে নেমে যায়। দুই ব্যাগ প্লাজমা দিলে প্লাটিলেট ২৬ হাজারে ওঠে। কিন্তু পরিস্থিতি বেশি খারাপ হওয়ায় ভর্তির দুদিন পর ৮ অক্টোবর তুষার মারা যান।

এই রোগীর ব্যাপারে জানতে চাইলে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গি পজিটিভ হয়েও প্রথমে শনাক্ত হয়নি। হয়তো ওষুধ খেয়ে সাময়িকভাবে জ্বর কমেছে। কিন্তু রোগ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ না খাওয়ায় উলটো ফল হয়েছে। চিকিৎসা বিলম্বে রোগীর মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ ও কালো পায়খানা হয়েছে। পেটে ব্যথা, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট ও বমি হয়েছে। এতে রক্তনালি থেকে প্লাজমা বেরিয়ে যায় (রক্তের প্লাজমা লিকেজ) এবং প্লাটিলেটের সংখ্যা কমতে থাকে। ফুসফুস ও পেটে পানি জমে যায়। এ লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার জন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য। সুস্থতার পর্যায়েও নিবিড় পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখা উচিত। সময় মতো সঠিক চিকিৎসা না নেওয়া রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ডেঙ্গি ভাইরাল জ্বর হওয়ায় সাধারণত এন্টিবায়োটি ওষুধ লাগে না। রোগী এন্টিবায়োটিক খেয়েছে কিনা সেটিও দেখতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচর্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সর্দিজ্বর হলেই রোগীরা অস্থির হয়ে যান। ফার্মাসিস্ট ও চিকিৎসকরাও এন্টিবায়োটিক ওষুধ লিখে দেন। অথচ রোগটি সাধারণ জ্বর নাকি ডেঙ্গি সেটি আগে শনাক্ত করেন না। ডেঙ্গিজ্বর সাধারণত কয়েক স্তরের হয়ে থাকে। যেমন-ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গিজ্বর, হেমোরেজিক ডেঙ্গিজ্বর (ডিএইচএফ) এবং ডেঙ্গি শক সিনড্রোম (ডিএসএস)। ডিএসএস হলো ডিএইচএফের পরের ধাপ এবং তা খুবই বিপজ্জনক। শরীরের ফ্লুইড বের হয়ে যাওয়ার কারণে হঠাৎ শকে মানুষ মারা যায়। এক্ষেত্রে রোগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা করাতে হয়। মারাত্মক রোগীর ক্ষেত্রে পানিস্বল্পতা ও রক্তক্ষরণের চিকিৎসার জন্য আইভি স্যালাইন বা রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here