খবর৭১ঃ দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পরে মুসলমানগণ পালন করে থাকেন তাদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। মুসলিম দেশগুলোতে এই দিনটি পালিত হয় নানা উৎসব ও আয়োজনের মধ্যদিয়ে। দেশ ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এ দিনটি পালনে লক্ষ্য করা যায় আনন্দঘন সব আয়োজন। কোথাও যেন আনন্দের কমতি নেই। এটি যে আনন্দের দিন শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ মুসলিম মিল্লাতকে যেন তা-ই জানান দিয়ে যায়। তাই আনন্দে মাতোয়ারা হয় পুরো মুসলিম বিশ্ব।
সৌদি আরব : এই দিনে পুরুষরা কান্দর নামের সাদা পোশাক পরিধান করে মাথায় দেয় গাহফিহ নামের টুপি। নারীরা এই দিনে থাউব নামের বিশেষ পোশাক পরে থাকে। ঈদের দিন সৌদি মুসলিমরা বাজার থেকে বেশি পরিমাণে চাল কিনে আনে। আর তা বাড়ির প্রবেশ দরজার বাইরে রেখে দেয়। যাতে অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মানুষ তা নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে পারে। এছাড়াও এই দিনটিতে গরিবদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। ঈদ উপলক্ষে দেশটিতে তিন দিন সরকারি ছুটি থাকে। ঈদের নামাজ শেষে বাড়িতে বিশেষ খাবার রান্না হয়। শিশুদের উপহার হিসেবে নগদ অর্থ দেয়া হয়। এই দিনে অনেক দোকানি ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ছাড়া প্রদান করে। মানুষের মাঝে উদারতার কোনো কমতি থাকে না এই দিনে। ঈদকে কেন্দ্র করে বাড়ি-ঘর সাজানো, ঈদ সেলামি, ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন, অতিথি আপ্যায়ন এসব তো আছেই এমনকি অমুসলিমদের উপহার দিতেও তারা ভোলে না।
আফগানিস্তান: ঈদের দিনে তারা আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাড়ি বেড়াতে যায়। ঈদের দিনে তারা অতিথিদের খেতে দেয় ‘জালেবি’ নামের এক বিশেষ খাবার। আর ‘তখম জাঙ্গি’ আফগানদের ঈদ উদ্যাপনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ‘তখম জাঙ্গি’ হলো পুরুষেরা ফাঁকা ময়দানে একত্রিত হয়ে একজন আরেকজনের দিক সিদ্ধ ডিম ছোড়া। ছোটরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। এ সময় তারা বলতে থাকে, ‘খালা ঈদেত মোবারক’।
ইন্দোনেশিয়া : বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। ঈদের দিনকে ইন্দোনেশিয়ায় বলা হয় ‘হারি রায়া ঈদুল ফিতরি’। এদিনটি ‘লেবারান’ হিসেবেও পরিচিত। ঈদের দিনে তারা বিগত বছরের কৃতকর্মের জন্য আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের কাছে কাছে ক্ষমা চায়। ঈদের এই বিশেষ দিনটিতে নারীরা সে দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘কেবায়া কুরঙ্গ’ আর পুরুষরা পরে ‘বাজু কোকো’। যা সে দেশের ঐহিত্যবাহী পোশাক। ঈদের দিন তারা সমাধিস্থলে যায়। সেখানে গিয়ে কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও মোনাজাত করে । ঈদের দিন বিশেষ খাবার হিসেবে তারা কেতুপাত, দোদোল, লেমাং নামের বিভিন্ন খাবার রান্না করে। ঘর সাজাতে তারা ‘পেলিটাস’ বা প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকে।
ভারত : এদিন স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সরকারি অফিস আদালত এমনটি কিছু কিছু দোকান-পাট ও রেস্টুরেন্টও বন্ধ থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একদিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ঈদগাহ ও বড় বড় জামে মসজিদগুলোতে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। চাঁদরাতে মেয়েরা হাতে মেহেদি লাগায়। ক্ষুদে বার্তা বা টেলিফোনের মাধ্যমে একে অপরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। এমনকি অমুসলিম প্রতিবেশীরাও তাদের মুসলিম বন্ধুদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকে। আবার অনেকে এই চাঁদরাতে কেনাকাটা করতে যায়। ঈদের দিন রাত পোহালের পুরুষেরা ঈদের নামাজ শেষে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। একে অপরের সাথে কোলাকুলি আর শুভেচ্ছা বিনিময়ে ভাগাভাগি হয়।
পাকিস্তান : ঈদের আগে এখানে অনেকেই কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করে। বিশেষ করে নারীরা। তারা প্রিয়জনদের ঈদকার্ড পাঠিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। ঈদের দিন সকালে গোসল সেরে নতুন জামা পরে মসজিদে বা ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে যায়। বড় বড় খেলার মাঠ ও পার্কে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে দুঃস্থ ও অসহায় মানুষদের দান-খয়রাত করা হয়। অনেকে আবার পরিবারের বাকি সদস্যদের জন্য মিষ্টিসহ অন্যান্য উপহার সামগ্রীও কিনে থাকেন। ঈদের দিন সকালে পরিবারের সবাই এক হয়ে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, ঐতিহ্যবাহী শির-কোরমা দিয়ে নাশতা করে। টিভির পর্দায় সারাদিন ঈদ নিয়ে থাকে নানা আয়োজন। অনেকে পার্ক, মনোরাম স্থান ও সাগর তীরে ঘুরতে যায়।
তুরস্ক : ঈদের দিন সবাই নতুন পোশাক পরে নামাজ আদায় করতে যায়। নামাজ শেষে শুরু হয় পরস্পরের শুভেচ্ছা বিনিময়। আপনজনের রুহের মাগফিরাতের জন্য কবরস্থানে গিয়ে তারা দোয়া-প্রার্থনায় ব্যস্ত থাকে। বড়দের ডান হাতে চুম্বনের মাধ্যমে তাদের প্রতি গীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ঈদের দিনকে তারা ‘রামাদান বেরামি’ বা রামাদান উৎসব ও ‘সেকার বেরামি’ বা মিষ্টির উৎসব বলে আখ্যায়িত করে। শিশুরা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য বাড়ি বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়, এ সময় তাদের ‘তুর্কিস ডিলাইট’, ‘বাকলাভা’ সহ অন্যান্য মিষ্টি খেতে দেয়া হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য ‘শ্যাডো পাপেট শো’র ব্যবস্থা করা হয়।
মালয়েশিয়া : সবাই নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালন করে থাকে। সে দেশে ঈদের আগের রাতকে বলা হয় তাকবিরান। মসজিদ ও রাস্তায় তাকবির ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে। ঈদের দিনে সবাই ঈদগাহে নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে একজন আরেকজনের সাথে কোলাকুলি করে। ঈদের দিন মুসলমানরা ঐতিহ্য অনুযায়ী ওপেন হাউস পালন করে, এদিন যে কেউ কারও বাড়িতে অতিথি হয়ে আসতে পারে। মুখরোচক বিভিন্ন ধরণের খাবার রান্না হয় ঘরে ঘরে। খাবার তালিকায় থাকে মাংসের তৈরি ‘রেনডাং’, কাবাব বা ‘কেটুপাত’, ‘ডোডল’ বা একধরনের মিষ্টি। এছাড়াও সে দেশের বিশেষ ঐতিহ্য বাঁশের মধ্যে রান্না করা ভাত, যা ‘লেমাং’ নামে পরিচিত।
মরক্কো: ঈদের নামাজ আদায় করে সবাই একত্রিত হয়। ঈদের আগের দিন নারীরা বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার ও পিঠা-পুলি তৈরি করে। সকালের নাশতায় তারা পুদিনা পাতার চায়ের সাথে ‘মেসেমেন’ ও ‘বাঘরির’ নামের পিঠা খায়। পুরুষরা জুতার সাথে জেলাবা বা জাবাদোর নামক পোশাক পরে থাকে। যা মরক্কোর ঐতিহ্য। নারীরা পরে ‘কাফতান’ নামক পোশাক।
সিঙ্গাপুর: আঞ্চলিক ভাষায় সিঙ্গাপুরে ঈদের দিনটিকে বলা হয় ‘হরি রয়া পসা’। রমজান মাস আসার পর থেকেই মূলত সিঙ্গাপুরের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ঈদের আমেজ বইতে শুরু করে। সেখানকার বাড়িঘর, দোকানপাট, রাস্তাঘাটে আগে থেকেই আলোকসজ্জা করা হয়।
আমেরিকা: এখানে ঈদের নামাজ পড়া হয় বিভিন্ন ইসলামিক সেন্টার, কনভেনশন হল ও পাকের্র মতো উন্মুক্ত স্থানে। এদেশে বসবাসরত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলিমরা একসাথে ঈদের নামাজ আদায় করে। কিছু শহর আছে, যেখানে ঈদের নামাজ আদায় করতে এত বেশি লোক সমাগম হয় যে, কয়েক দফায় ঈদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রাখতে হয়। এই দিনটি উদ্যাপন উপলক্ষে আমেরিকার পোস্ট অফিসের পক্ষ থেকে বিশেষ স্ট্যাম্প প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য যে, ২০০১ সাল থেকে মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে ইউনাইটেড স্টেটস পোস্টাল সার্ভিস ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর ঈদ স্ট্যাম্প প্রকাশ করে আসছে। এদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে ছুটি না থাকলেও মুসলিমরা কাজ থেকে বিশেষ ছুটি গ্রহণ করে থাকে।