মিজানুর রহমান মিলন, সৈয়দপুর থেকে: সৈয়দপুর উপজেলার গ্রামে গণপিটুনিতে নিহত এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর পার্শ্ববর্তী চিরিরবন্দর থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম আব্দুর রহমান (৪০)। এই মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউপির পশ্চিম বালাপাড়া গ্রামে। এতে ১৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০/১৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। ফলে পুলিশী হয়রানী ও গ্রেফতার আতংকে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে পুরো গ্রাম। এলাকা জুড়ে বিরাজ করছে থমথমে পরিবেশ। গত আটদিন যাবত গ্রামে হাতেগোনা কয়েকজন বয়স্ক নারী, শিশু, স্কুল শিক্ষার্থী ও গবাদিপশু ছাড়া বসতভিটায় কেউ নেই।
জানা যায়, গত ১৪ জানুয়ারী গভীর রাতে বোতলাগাড়ী ইউপির পশ্চিম বালাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ভ্যানচালক হোসেন আলীর বাড়িতে তিন চোর প্রবেশ করে। এ সময় গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে চোর সন্দেহে আটক একজনের ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয়। পরদিন শনিবার সকালে হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে সৈয়দপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় পুলিশ লাশের সন্ধানে গ্রামজুড়ে তদন্তে নামে। তদন্তের একপর্যায়ে চিরিরবন্দর উপজেলার ঠাকুরেরহাট জোতরঘু এলাকায় ডালিয়া ক্যানেলে লাশের সন্ধান পায়। পরে চিরিরবন্দর পুলিশ ক্যানেল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে নিহতের পরিবারের সদস্যরা থানায় হাজির হয়ে মরদেহের পরিচয় সনাক্ত করে। নিহত ব্যক্তি প গড় জেলা শহরের চানপাড়া এলাকার মফিজ উদ্দিনের ছেলে। এ ঘটনায় চিরিরবন্দর উপজেলার ফতেজংপুর ইউপির গ্রাম পুলিশ আব্দুর রহিম বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত মোট ৩০ জনকে আসামী করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ ৩ জনকে গ্রেফতার করে দিনাজপুর জেল হাজতে প্রেরণ করেছে। এরা হলেন সৈয়দপুর উপজেলার পশ্চিম বালাপাড়া গ্রামের হোসেন আলীর স্ত্রী তাহেরা বেগম (৪০), তার ছেলে খায়রুল ইসলাম (৩০) ও আব্দুর রহমানের ছেলে মোখলেছুর রহমান (২৪)।
এদিকে সরেজমিনে ঘটনাস্থল পশ্চিম বালাপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রাম জুড়ে বিরাজ করছে সুনশান নিরবতা। খোঁজাখুজির পর এলাকায় দেখা মিলল কয়েকজন বয়স্ক নারী, শিশু ও স্কুল পড়ুয়া তরুণের। তাদের সকলের চোখে মুখে রয়েছে আতংকের ছাপ। কথা হলে তারা জানান, গ্রামের পুরুষ ও যুবকরা আতংকে ঘটনার পর থেকে বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রতি রাতে পুলিশ এসে লোকজনের খোঁজখবর করছে। আমরা সবাই ভয়ের মধ্যে বাড়িতে অবস্থান করছি।
গ্রামের বয়স্ক বাসিন্দা রশিদা বেগম ও পারুল বেগম নামের দুই গৃহবধূ জানান, এই গ্রামের মানুষ সবজি চাষ, অটোরিক্সা ও ভ্যান চালানোর পেশায় জড়িত। ঘটনার পর থেকে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাদের স্বামীরাও গ্রেফতার এড়াতে গাঢাকা দিয়ে আছেন। আমাদের এখন কঠিন সমস্যা ক্ষেতে ফলানো ফুল কপি, বেগুন, আলু, সীম, শাক বিক্রি করতে পারছি না। শীতের শাক সবজি ক্ষেতে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকায় বিক্রি করা যাচ্ছে না সবজি। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে, অর্থ কষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি আমরা। কষ্টে ফলানো ফসল ক্ষেতে নষ্ট হয়ে গেলে লাখ লাখ টাকা লোকসান গুণতে হবে। দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুমও হারাম হয়ে গেছে।
একই এলাকার দশম শ্রেণির স্কুল ছাত্র জাকির হোসেন বলেন, প্রতিদিনই টহল পুলিশ গ্রামে আসছে। ভয়ে রাতের বেলা অন্যের বাড়িতে গিয়ে থাকতে হচ্ছে। স্কুলের লেখাপড়া ঠিকমত করতে পারছি না। বাবাও বাড়ি ছাড়া হয়ে লুকিয়ে রয়েছেন। এ গ্রামের ৫০ ঘর পরিবারের দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ, যুবক গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আছেন। সেদিনের ঘটনা জানতে চাইলে বলেন, বাড়িতে চোর ঢোকার হৈইচৈই শুনেছি, এর বেশি কিছু জানি না। একই গ্রামের স্কুল ছাত্রী রূপালী, সুমী ও লাবনীর সঙ্গে কথা বললে তারাও একইভাবে পুলিশের ভয়ভীতির কথা জানায়।
এ ব্যাপারে বোতলাগাড়ীর ইউপির ওই এলাকার নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য মহির উদ্দিন বলেন, মামলার আসামী হিসাবে অজ্ঞাতনামা উল্লেখ থাকায় নির্দোষী মানুষ বেকায়দায় পড়েছেন। ফলে গ্রেফতার আতংকে নারী-পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে গোটা গ্রাম। গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষ সবজি চাষ করে সংসার চালান। এ অবস্থায় পুরুষ লোক না থাকায় ক্ষেতেই মূল্যবান সবজি নষ্ট হচ্ছে। এতে তারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তিনি গ্রামের আতংক পরিস্থিতি অবসানে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জানতে চাইলে, সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ আবুল হাসনাত খান জানান, হত্যাকান্ডের ঘটনা যদিও সৈয়দপুর, কিন্তু মরদেহ উদ্ধার হয়েছে পার্শ্ববর্তী চিরিরবন্দর থানা এলাকায়। তাই মামলাটি ওই থানা তদন্ত করছে। তবে তারা সহায়তা চাইলে আমরা সহযোগিতা করবো মাত্র।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও চিরিরবন্দর থানার এসআই তাজুল ইসলাম জানান, গ্রেফতার ৩ জন আসামীকে আদালতের মাধ্যমে দিনাজপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতার আসামীরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার বাকি আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তিনি পুলিশী আতংকে গ্রাম পুরুষ শূন্য প্রশ্নে বলেন, কেউ গ্রাম ছাড়া হলে ধরে নিতে হবে সে অপরাধে জড়িত থাকতে পারে। তবে নির্দোষ নিরীহ মানুষের ভয়ের কিছু নেই। তারা নির্ভয়ে বাড়ি ঘরে থাকতে পারেন বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।