অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ:
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আজ। ১৬ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অর্জন আছে, হয়ত সেই অর্জন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মত না ও হতে পারে। রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের কারণে এর আকর্ষণ অন্য রকমের। যখন জগন্নাথ কলেজ ছিল তখনো অন্যরকমের আবেদন ছিল। বাংলাদেশে ও দেশের বাইরে অনেক পেশাজীবী এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছেন। অনেক রাজনীতিবিদ এখানেই লেখাপড়া করেছেন। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও এখানে বসে আইন বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে সে কথা বলেছেন। এর রকম অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ধারণ করছেন।
‘জগাবাবুর পাঠশালা’ বা যে নামেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অভিহিত হোক না কেন এর একটি অহংকারী ভিত্তি আছে। তবে যে প্রক্রিয়ায় জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে তা ছিল অনেকটাই ক্রটিপূর্ণ।
সাধারণত: একটি নতুন পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার একটি অবকাঠামোগত পরিকল্পনা থাকে। এর কোনটাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল না।কলেজ আমলের কতগুলো ছাত্রাবাস ছিল যার অনেকগুলোই বেহাত হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ঠিকমত পরিচালিত হতো কি না জানা নেই । মাঝে মধ্যে এলাকাবাসীর সাথে ছাত্রদের কলহ বিবাদ হতো। হল পরিচালনার ব্যাপারে যেভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পরিচালিত হয় তার অনেকটাই ছিল না। স্বাধীনতার পর কয়েকবছর হলগুলো মোটামুটি সচল ছিল। হলগুলো কিভাবে পরিচালিত হতো, কিংবা এর প্রশাসনিক কার্যক্রম কতটা কলেজ কর্তৃপক্ষে নিয়ন্ত্রণে ছিল তা জানা নেই। এভাবে এগুলো একে একে হাতছাড়া হতে থাকে। এরশাদের আমল থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু। প্রভাবশালীদের দখলে চলে যেতে থাকে এক একটি হল।
মাঝে মধ্যে পত্রপত্রিকায় এসব হলের ভেতরে সংঘঠিত বিভিন্ন ঘটনার সত্য/মিথ্যা বিবরণ প্রকাশিত হতো। আর হলগুলোর অবস্থান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। দীর্ঘ অনেক বছর এই কলেজ আর তথাকথিত হলেগুলোও নিয়ন্ত্রিত হতো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির দ্বারা-এক সময়ে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়েও নানারকম প্রশ্ন উঠতে থাকে তারপরও জগন্নাথ তার স্বকীয় মহিমায় এগিয়ে গিয়েছে এবং যার ফলশ্রæতিতে ২০০৫ সালে এটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর অবকাঠামো কলেজ আমলের মতোই রয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিকল্পিত কিছুই এখানে নেই, শুধু রাজধানী বলে এর একটি গুরুত্ব আছে।স্বাভাবিক কারণেই এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য অনেক সুবিধাদি আশা করে, আবার এর মধ্যে অনেকে সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যান।
এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭/৪ ধারা নামে একটি ধারা ছিল। ধারাটি ছিল পাঁচ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব আয়ে চলবে। এই ধারার মধ্যে আর কি কি শর্ত সন্নিবিশিত ছিল তা আমার এই মুহুর্তে জানা নেই। একই ধারার বলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এর বিরুদ্ধে এই জগন্নাথের ছাত্র-ছাত্রীরা ২০১১ সালে এক জোরালে আন্দোলন গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে এলেন এই সমস্যা সমাধানের জন্য। আমরা একদল সিনিয়র শিক্ষক উপাচার্য প্রফেসর ড. মেজবাহ উদ্দীন আহমদ এর নেতৃত্বে সহযোগিতা করি এবং এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী হস্তাক্ষেপ কামনা করি। তিনি প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বললেন এটা তো বিশ্ববিদ্যালয় করাই ঠিক হয়নি। আসলে তিনি অবকাঠামোগত অপ্রতুলতার কথা ভেবেই কথাটি বলেছিলেন। সেজন্যই ২৭/৪ ধারা বাতিলের ঘোষণা দেন এবং বিল আকারে এটি সংসদে উথাপন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন এবং বাতিল করেন।
সেই থেকে আসলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্নাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। নিজস্ব আয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়া মানে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় টিউশন ফি পরিশোধ করা। সেজন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম দেখাতেই আমাদেরকে বলেছিলেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এতো বেতন কিভাবে দিবে। ১৬ বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন অনেক। সবচেয়ে ঈর্ষনীয় হলো এর শিক্ষকমন্ডলী। বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে অনেক শিক্ষক এখানে পড়াচ্ছেন ও গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেছেন। এসব অভিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলীর সান্নিধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখন অনেক উচুঁতে।
দেশব্যাপী বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজে তাদের ভূমিকা প্রশংসাযোগ্য। অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় কেরাণীগঞ্জে ২০০ একর জায়গায় নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রাথমিক কাজ এগিয়ে চলছে। শীঘ্রই মাস্টারপ্লান প্রণীত হবে। এরই মধ্যে বাউন্ডারী ওয়ালের কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যায়। সীমাবদ্ধতা অনেক আছে। তারপরও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আশাহত নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শেখ হাসিনার হাত ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই অভীষ্ট লক্ষে এগিয়ে যাবে, অগণিত শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণে পুরান ঢাকার ঐহিত্য রক্ষার্থে অর্থবহ ভূমিকা পালন করবে।
(লেখক: ট্রেজারার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)