খবর৭১ঃ কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়া যাওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট ঘটনার পেছনে কারা রয়েছে তাদের খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ঘটনার তদন্ত চলছে, জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানান সরকারপ্রধান।
বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি আয়োজিত শারদীয় দুর্গাপূজার মহানবমীর অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপে ভক্তদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কুমিল্লায় যে ঘটনা ঘটেছে, তার তদন্ত হচ্ছে। ব্যাপকভাবেই তদন্ত হচ্ছে। অনেক তথ্যও আমরা পাচ্ছি। এবং অবশ্যই এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটাবে, তাদেরকে আমরা খুঁজে বের করবোই। তা আমরা করতে পারবো। এখন প্রযুক্তির যুগ। বের করা যাবে। সে যেই হোক না কেন, যে ধর্মের হোক না কেন। তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে। কারণ আমরা তা করেছি এবং করবো।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে ঘটনাটা ঘটেছে সাথে সাথেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। সর্বক্ষণ আমরা যোগযোগ রাখছিলাম। এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যেখানে যেখানে যারাই এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে, সঙ্গে সঙ্গেই তাদের খুঁজে বের করা হবে। এটা আমরা অতীতেও করেছি এবং সেটা করতে পারবো। যথাযথ শাস্তি তাদের দিতে হবে। এমন শাস্তি যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ সাহস না পায়। সেটাই আমরা চাই।’
কিছু মানুষের ভেতরে এই দুষ্টু বুদ্ধিটা আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যখন একটা জিনিস খুব সুন্দরভাবে চলছে, সেটাকে নষ্ট করা। আর বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সময় এ যাত্রাটাকে ব্যাহত করা। সেই সাথে সাথে দেশের ভেতরে একটা সমস্যা সৃষ্টি করা।’
জনগণে যাদের আস্থা নেই তারাই এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারে না, রাজনীতি নেই, কোনো আদর্শ নেই, আসলে তারাই এ ধরনের কাজ করে। এটা অনেকটা তাদের দুর্বলতা। কিন্তু এর বিরুদ্ধে যদি সবাই সচেতন থাকে, তাহলে অবশ্যই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সভাপতি (মহানগর সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার) যে শঙ্কার কথা বলেছেন। আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে জানি। আমরা যথযথ ব্যবস্থাও নিচ্ছি।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশে যার যার ধর্ম, সে সে পালন করবে। অর্থাৎ ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এটা কিন্তু বাংলাদেশে সবসময় ছিল এবং আছে। প্রত্যেকটা উৎসবে সবাই এক সঙ্গে শামিল হয়ে উপভোগ করে। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু কিছু দুষ্টু চক্র, কিছু ঘটনা ঘটিয়ে মানুষের ভেতরে এ চেতনাটা নষ্ট করতে চায়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা নিজেরা, নিজেদের ক্ষুদ্র সম্প্রদায় মনে করবেন কেন? এই মাটিতে আপনাদের জন্ম। আপনারা এই মাটিরই সন্তান। সবাই নিজের অধিকারে বসবাস করেন। এখানে নিজেদের কখনোই সংখ্যাগুরু-সংখ্যালগিষ্ঠ এই সংখ্যা দিয়ে বিচার না করাই ভালো। আপনি স্বাধীন বাংলায়, একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বসবাস করবেন। সেই আত্মবিশ্বাসটা আপনাদের মাঝে থাকতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আপনাদের সংখ্যালঘু না, আপনজন হিসেবে মানি। এই দেশের নাগরিক হিসেবে মানি। সমঅধিকারে আপনারা বসবাস করেন। সেটা ভোগ করবেন। সমঅধিকার নিয়ে আপনারা ধর্ম ও উৎসব পালন করবেন। সেটাই আমরা চাই। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের আসল নীতি ও আদর্শ। আমাদের ইসলাম ধর্মেও কিন্তু সব ধর্মের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে।’
কিছু লোক ধর্মান্ধতায় ভোগেনে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা সবসময় সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে চান, এটা শুধু মুসলমান হিসেবে না, সব ধর্মেই কিন্তু ধর্মান্ধ শ্রেণিটা আছে। তারা সবসময়ই একটা কিছু করার চেষ্টা করে। আমরা সবাই যদি এক হয়ে চলি, তাহলে তারা এই ক্ষতিটা করতে পারবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্গোৎসব যেহেতু এই দেশে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এখানে অনেক সার্বজনীন পূজামণ্ডপ হয়। আবার কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক পূজামণ্ডপ হয়। এই পূজামণ্ডপ কিন্তু বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। আমরা প্রতিটি জায়গায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। সার্বজনীন পূজামণ্ডপে কোনো অসুবিধা হয় না। অসুবিধা হয়ে যায়, আলাদা আলাদা অথবা যেখানে অস্থায়ী মন্দির বসিয়ে যখন পূজা করা হয়, তখনই কিছু লোক সুযোগ পায় সেখানে সমস্যা সৃষ্টি করতে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এক্ষেত্রে আপনাদের পক্ষ থেকেই কিছুটা বোধহয় নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। যে মোট কত জায়গায়… এটা কিন্তু ভারতেও আছে। কলকাতায়ও আছে। সেখানে কিন্তু সরকারের অনুমোদন ছাড়া নতুন করে পূজামণ্ডপ করতে পারে না। কিন্তু আমাদের এখানে সেই স্বাধীনতা আছে, আপনারা করতে পারেন। কিন্তু আমি চাইবো আপনারাই পদক্ষেপ নেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের একটা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। নির্দেশনা থাকা দরকার যে, কোথায়, কতটা পূজামণ্ডপ হবে। এটা যদি সীমিত আকারে থাকে তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়ার সুবিধা থাকে।’
আওয়ামী লীগ, সহযোগী এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নিজ নিজ এলাকার পূজামণ্ডপের নিরাপত্তার দিকটা খেয়াল রাখার নির্দেশনা দেন দলটির সভাপতি। তিনি বলেন, ‘সারাবিশ্বে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়াতে তার একটা প্রভাব এসে পড়ছে। সেটা শুধু আমাদের নিজেদের দেশেই না। আমাদের প্রতিবেশী দেশকেও এ ব্যাপারে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোগিতা করেছিল। তাদের কথা আমরা সবসময়ই কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্মরণ করি। সেখানেও এমন কিছু না করা হয়, যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে। আর আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে। এ ব্যাপারে তাদেরকে একটু সচেতন থাকতে হবে। আমার একটু অনুরোধ।’
হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, মুসলমানরা তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা হেবা সূত্রে কোনো সম্পদ পেলে তার ট্যাক্স দিতে হয় না। হিন্দু সম্প্রদায়ে বাবা-মায়ের সম্পত্তিতে সন্তানদের যে অধিকার, সেটা যাতে যথাযথভাবে পায়। সেই ব্যবস্থাটা আমরা করে দিয়েছি।
সরকারপ্রধান বলেন, শত্রু সম্পত্তি নিয়ে অনেক কথা ছিল। শত্রু সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনও আমরা করে দিয়েছি। কারণ এখানে শত্রু বলে কেউ নাই। শত্রু কে? এখনতো সবাই সমান। সবাই সকল নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। সেটাই করে দিয়েছি।
হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট আইন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ তহবিলে ১০০ কোটি টাকা আমরা দিয়েছি। অনেকইতো অর্থশালী ও সম্পদশালী আছেন। নতুন নতুন পূজামণ্ডপ করতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করেন। এত বেশি টাকা ওখানে খরচ না করে ট্রাস্টে কিছু টাকা অনুদান দেন।
মহানগর সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদারের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্নাত্মানন্দ মহারাজ, মহানগর সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিশোর রঞ্জন মন্ডল।