খবর৭১ঃ অতি সম্প্রতি দফায় দফায় ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে বিভাগীয় শহর সিলেট। এসবকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আট মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। আর এ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে প্রায় এক থেকে দুই লাখ মানুষের প্রাণহানি হবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ভবনগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ভূমিকম্পের কারণে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি ও ঝুঁকি কমাতে সচেতনতা মহড়া বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ- এ তিন গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এর মধ্য ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত সিলেট যার উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’। এ প্লেটগুলো সক্রিয় থাকায় এবং পরস্পর পরস্পরের দিকে ধাবমান হওয়ায় এখানে প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে। আর জমে থাকা এসব শক্তি যে কোনো সময় ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে। ফলে অতিমাত্রায় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।
গবেষকরা বলছেন, ‘ডাউকি ফল্ট’ ও সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে গত পাঁচশ থেকে এক হাজার বছরে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তি না হওয়ায় সিলেটের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। এদিকে ২০১৫-১৬ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে এক থেকে দুই লাখ লোকের প্রাণহানি হতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ১৯২২ সালে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল হবিগঞ্জ অঞ্চলে; ১৯১৮ সালেও ৭.৫ মাত্রার হয়েছিল। চার বছরের ব্যবধানে বড় ভূকম্পন ছিল শত বছর আগে। এক মাস আগে ডাউকি ফল্টের উত্তর প্রান্তে আসাম সীমান্তে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। তার মানে এ ‘ডাউকি ফল্ট’ খুব সক্রিয়। ডাউকি ফল্ট ও টেকনাফ সাবডাকশন জোনে হাজার বছর ধরে যে পরিমাণ শক্তি ক্রমান্বয়ে সঞ্চয় হয়ে আসছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূকম্পন হতে পারে। এ শক্তি একবারেও বের হতে পারে; আবার আংশিক বের হতে পারে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে মানসিক প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঝুঁকি রয়েছে, সেজন্য আমরা হুমকির মুখেও রয়েছি। এ কারণে মানসিক প্রস্তুতি দরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে মহড়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেক বছর আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটা চলমান রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা- মহড়া প্রতি বছর করতে হবে। করোনায় যেমন মাস্ক আবশ্যক, ভূমিকম্পের সচেতনতায় মহড়াও তেমন আবশ্যক।
সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন- ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট সিটির মেয়রদের মহড়া আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বুয়েট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. দেলওয়ার হোসাই বলেন, ‘সাত মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন জায়গার স্ট্রাকচার নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ বেশিরভাগ স্ট্রাকচার সাতের বেশি ভূমিকম্পের প্রেসার নিতে পারবে না।’ বুয়েট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বিশ্বের অধিকাংশ ভূমিকম্পে ভবন চাপা পড়ে অধিকাংশ মানুষ মার গেছেন। আমাদের বিল্ডিংগুলো আসলে ভালো অবস্থাতে নেই। ঢাকাতে একটা প্রেডিকশন আছে, ২০১৫-১৬ সালে আমরা একটা স্টাডি করেছিলাম তখন আমরা বলেছিলাম এক থেকে দুই লাখ লোক হতাহত হবে। কারণ ঢাকায় লোক অনেক। ঢাকায় বাসা-বাড়ি আছে একুশ লাখ, চট্টগ্রামে আছে পাঁচ-ছয় লাখ। আর সিলেটে আছে এক লাখ।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকার বাড়িঘরের মধ্যে খুব কমই আছে ভূমিকম্প সহনশীল। এর মধ্যে তিন হাজার বিল্ডিং হয়তবা বেটার কারণ এগুলো বড়। আর বড় বিল্ডিং করার সময় মানুষ সতর্ক থাকে। এর মানে এগুলো বাদে সব বিল্ডিংই যে ভেঙে পড়বে তা নয়। তবে এগুলো চেক করতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর পাঁচ হাজার ফ্যাক্টরি চেক করে আমরা ৩৫ ভাগ খারাপ পেয়েছি। আর বাকি ৬৫ ভাগ কিন্তু ভালো ছিল। সুতরাং চেক না করে বলা মুশকিল।’ বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকার অর্ধেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন তথ্য সঠিক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ প্রেডিকশন ঠিক না। ওটা আসলে চেক না করে বলা মুশকিল।’
ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের করণীয়ের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার জন্য বিল্ডিং কোড মেনে সঠিক গ্রাউন্ড মোশন নিয়ে বিল্ডিং ডিজাইন করতে হবে। সঠিক গ্রাউন্ড মোশন ধরে বিল্ডিং ডিজাইন করলে বিল্ডিং পড়বে না। আরেকটি হলো একেবারেই পুরাতন বিল্ডিং যেগুলো রয়েছে সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। আর যেগুলো মোটামুটি অবস্থায় আছে সেগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচর্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, মাঝারি ভূমিকম্পও আমাদের দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ আমাদের দেশের ভবনগুলো দুর্বল এবং ভূমিকম্প সহনশীল নয়। ভূমিকম্পের ঝুঁকি যদি আমরা হ্রাস করতে চাই প্রথম কাজ হবে- ভূমিকম্পে ঝুঁকি কেন তার একটি মানচিত্র তৈরি করা। বিশেষ করে শহর এলাকার কোন জায়গার মাটি দুর্বল, কোন জায়গার শক্তিশালী- তা বিবেচনায় নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। প্রাইভেট যে বাড়িঘর হয়ে গেছে সেগুলোতো পরিবর্বতন করা এত সহজ নয়। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। সেইক্ষেত্রে প্রথম কাজ হলো নগরবাসীকে সচেতন করা।