স্টাফ রিপোটার, বাগেরহাট: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুরক্ষা কবজ ও উপকূলীয় মানুষের ঢাল হিসেবে পরিচিত পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। কিন্তু চোরা কারবারি ও শিকারিদের অপতৎপরতা, একাধিকবার অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনায় দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনে সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ৷ এর ফলে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে সুন্দরবনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, নানা প্রজাতির মাছসহ আকর্ষণীয় সব প্রাণী।
গত ২০ বছরে সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগে ২৪ বার অগ্নিকান্ডর ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকান্ডে সুন্দরবনের ৭১ একর ৭০ শতাংশ বনভূমির গাছ, বিভিন্ন ধরনের ঘাস, লতাপাতা পুড়ে যায়। এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমান দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা।
এদিকে অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপন ও ভবিষ্যতে অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে করা সুপারিশ করা হলেও তা এখনও বাস্তবায়তি হয়নি। তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে অনাকাক্ষিত এ ঘটনা এড়ানো যেতো বলে দাবি সুন্দরবন বিশেষজ্ঞদের। প্রতিটি অগ্নিকান্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ও পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। সেসব রিপোর্টের প্রতিফলন বাস্তবে দেখা যায় না। ফাইল বন্দিই থেকে যায়। তবে, শিগগিরই তদন্ত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে বলে দাবি করেছেন সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মাদ বেলায়েত হোসেন।
অগ্নিকান্ডের পরে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে আগুন লাগার মূল কারণ হিসেবে মৌয়ালীদের ব্যবহৃত আগুনের কুন্ডলী, জেলেদের সিগারেট, দাবদাহ, বৃষ্টিহীনতা, খরা, বন অপরাধে সাজা প্রাপ্তদের প্রতিশোধ মূলক ব্যবস্থা, বাঘ তাড়ানোর জন্য আগুন ধরানো, গাজী কালুর উদ্দেশ্যে বনের মধ্যে সিন্নি পাক, দুষ্কৃতকারীদের মাধ্যমে বনের মধ্যে আগুন ধরানোকে দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া বর্ষাকালে মাছ শিকারের সুবিধার্থে স্থানীয় চক্রের যোগসাজসে আগুন লাগানোর বিষয়টিও উঠে আসে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। একইসঙ্গে আগুনের স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে বিভিন্ন গাছের পাতার পুরু স্তরের কথাও উল্লেখ করেছে একাধিক তদন্ত কমিটি। অগ্নিকান্ড এড়াতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশ তিনটি হচ্ছে, সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী ও খাল খনন, অগ্নিকান্ড প্রবন এলাকায় প্রতি ২ কিলোমিটার পরপর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা, চাঁদপাই রেঞ্জের ভোলা নদীর কোল ঘেষে বনের পাশ দিয়ে কাটাতাঁর অথবা নাইলোনের রশির নেট দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এর পাশাপাশি, বনের মধ্যে প্রবেশের সময় দাহ্য পদার্থ (বিড়ি, সিগারেট) বহন নিষেধ, সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে স্থানীয় জন প্রতিনিধি, ইমাম, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত নিয়মিত সমাবেশ করা, সুন্দরবন সংলগ্ন হাট-বাজারে মাইকিং করে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ ও অগ্নিকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির বিধান জানিয়ে দেওয়া। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ দল গঠন করে সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করা, লোকালয় সংলগ্ন বন বিভাগের অফিসে অগ্নি নির্বাপন সরঞ্জামাদি মজুদ রাখা এবং অগ্নি নির্বাপনে দক্ষ বন কর্মকর্তা-কর্মচারী গড়ে তোলার সুপারিশও করা হয় তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ণ হয়নি। পাশাপাশি অন্য সুপারিশগুলোর দুই একটি বাস্তবায়ন হলেও, বেশিরভাগই বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে অবাধে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে মৌয়ালী, বাওয়ালী, বনজীবী ও স্থানীয়রা। বনের মধ্যে প্রবেশ করা মৌয়ালী, বাওয়ালী, বনজীবী, স্থানীয় মানুষ ও দর্শনার্থীরা এখনও বনের মধ্যে অবাধে ধূমপান করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি অন্য অপরাধ তো রয়েছে।
বন সংলগ্ন এলাকার সচেতন মহল দাবি করছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজসে বনের মধ্যে মাছ ধরার জন্য আগুন ধরানো হয়। সেখানেই পরবর্তীতে জাল পেতে মাছ ধরেন জেলেরা। ফলে একের পর এক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে সুন্দরবনে।
এ বিষয়ে শরণখোলাস্থ সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে সুন্দরবন নজরদারিতে ব্যাঘাত ঘটে। আগুন থেকে সুন্দরবনমুক্ত রাখতে হলে নজরদারি বাড়ার পাশাপাশি বন সংলগ্ন এলাকায় সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনরক্ষীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ বিভিন্ন সময় উঠে আসে, সঠিক তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য লোকালয় সংলগ্ন নদী-খাল খনন ও কাটা তারের বেড়া দেওয়া খুবই জরুরি। এছাড়া বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্যরোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বাড়তে হবে। অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা বনজীবীদের বিড়ি-সিগারেটের থেকে অনেক সময় আগুন লাগে। এজন্য আমরা বনজীবী ও স্থানীয়দের সচেতন করেছি। সচেতনতামূলক কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত কমিটির যে সুপারিশে যে ওয়াচ টাওয়ার করার সুপারিশ ছিল। বন বিভাগের একটি প্রজেক্টে ওয়াচ টাওয়ার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রজেক্টটি পাস হলে আমরা টাওয়ার করব। টাওয়ার হলে আগুনের স্থান নির্ধারণ সহজ হবে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার ভরাট হওয়া নদী ও খাল খননের বিষয়েও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবনে ২০০২ সালে শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্য এলাকায়, ২০০৪ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্প এলাকায় এবং আড়ুয়াবের খালে, ২০০৫ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের আড়ুয়াবের খালের পশ্চিমে তুলাতলা ও খুটাবাড়ি এলাকায় আগুন লাগে। এরপরের বছর ২০০৬ সালেই তেরাবেকা খালের পাড়ে, আমুরবুনিয়া, কলমতেজিয়া, পচাকুড়ালিয়া বিল ও ধানসাগর স্টেশন এলাকায় মোট ৫টি অগ্নিকান্ডে ঘটনা ঘটে। ২০০৭ সালে বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী নলবন, পচাকুড়ালিয়া বিলে অগ্নিকান্ড ঘটে। ২০১০ সালে ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী, ২০১১ সালে ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, ২০১৪ সালে আবারও ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন বনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।
২০১৬ সালেও ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, পচাকুড়ালিয়া, তুলাতলী এবং ২০১৭ সালে একই স্টেশনের মাদরাসার ছিলা নামক স্থানে আগুন লাগে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আবারও ধানগারস স্টেশন এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৪ শতক বনভূমি পুড়ে যায় সুন্দরবনের। এই হিসাবে ২০০২ সালের ২২ মার্চ থেকে থেকে ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০ বছরে ২৪ বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে সুন্দরবনে।