খবর৭১ঃ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ভার্চুয়ালি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে কয়েকটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্ত সংঘাতের মতো যেসব বড় বড় ইস্যু দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে সেগুলো আলোচনায় স্থান পাবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
বৈঠকের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘সবকিছু নিয়েই কথা বলার সুযোগ আছে। সবগুলো নদী যাতে বিলিবণ্টন ঠিকমতো হয়, সেজন্য আমরা একটা ফ্রেমওয়ার্ক ডিজাইন করার চেষ্টা করছি। আমরা একটি কমপ্রিহেনসিভ আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে কাজ করতে চাই, সেই প্রচেষ্টা আমাদের আছে।’
এক বছরের বেশি সময় পর প্রতিবেশী দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যদিও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে তা হচ্ছে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি গত বছরের ৫ অক্টোবর নয়া দিল্লিতে সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।
ভার্চুয়ালি আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সেই তালিকায় নেই বহুল আলোচিত এবং বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত পানিবণ্টন, সীমান্ত সমস্যার মতো বিষয়।
তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের উদ্ধৃতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস জানিয়েছে, বৃহস্পতিবারের বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে নয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এই বৈঠককালে ঢাকা পানিবণ্টন, কোভিড সহযোগিতা, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ঘাটতি, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও রোহিঙ্গা সংকটসহ প্রধান সব দ্বিপক্ষীয় ইস্যু তুলে ধরবে। এছাড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সহযোগিতার বিষয়টি দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে।’
এছাড়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘে আরও জোরালো ভূমিকা রাখার জন্য ভারতকে আহ্বান জানাতে পারে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে পাঁচটি বিষয়ে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে: হাতি সংরক্ষণ, বরিশালে পয়ঃনিষ্কাশন প্ল্যান্ট স্থাপন, সামাজিক উন্নয়ন, হাইড্রো-কার্বন খাতে সহযোগিতা, কৃষিখাতে সহযোগিতা। এছাড়া ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল সংযোগটি ৫৫ বছর পর উদ্বোধন করা হবে।
তবে পানিবণ্টন, সীমান্ত সংঘাতের মতো ইস্যুতে আলোচনা বা সমঝোতা না হলে এসব ইস্যু ততটা গুরুত্ব বহন করে না বলে মনে করছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন। বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘যে এমইউও কথা বলা হচ্ছে, এগুলোর কোনোটাই আসলে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। যে বিষয়গুলো নিয়ে সবসময় কথাবার্তা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে, উদ্বেগ আছে, তার একটা ইস্যুও এখানে নেই। সেক্ষেত্রে আমি বলবো, পুরো বিষয়টার গুরুত্ব অনেকটা কমে আসছে।’
তবে তিনি মনে করেন, এমন সমঝোতার মধ্যে হাইড্রোকার্বন সেক্টরে সহযোগিতার বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব বহন করে। তিনি বলেন, ‘হাইড্রোকার্বন সেক্টরে যে কো-অপারেশনের কথাবার্তা হয়েছে, এটা অনেকটাই নতুন। একটা হতে পারে যে, যেহেতু সাগরে আমাদের পাশাপাশি অনেকগুলো ব্লক রয়েছে, সেখানে ভারতীয়রা হয়তো সহযোগিতা করতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। সেটা হলে বেশ উপকারী হবে।’
কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্তে প্রাণহানি বন্ধ না হলে এই বৈঠক বাংলাদেশের জন্য ততটা উপকারী হবে না বলেই তিনি মনে করেন।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘অনেকদিন ধরে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই, সেই যোগাযোগটা হচ্ছে, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া যে ইস্যুগুলো আছে বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে, এর কোনোটাকেই বিরাট কিছু মনে হচ্ছে না আমার কাছে।’
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি দুই দেশের সম্পর্কে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বেশ কয়েকবার আলোচনায় এলেও কোনো সমাধান আসেনি বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত কয়েকটি ইস্যুতে।
যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য আভাস দিয়েছেন, পানিবণ্টন, সীমান্ত প্রাণহানি, রোহিঙ্গা সংকট এবং করোনাভাইরাস মোকাবিলার মতো বিষয় আলোচনায় উঠতে পারে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে।
সেটা হোক বা না হোক, নানা ইস্যুতে দুই দেশের সমঝোতা স্বাক্ষর, বৈঠক ইতিবাচকভাবেই দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘যে সমঝোতাগুলো স্বাক্ষরের কথা বলা হচ্ছে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বা স্পর্শকাতর যে বিষয়গুলো রয়েছে, তার তুলনায় এগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে আমরা যে ট্রেন্ড দেখেছি, সেটা হলো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা। সেটা কিন্তু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
এই অধ্যাপক বলেন, ‘স্পর্শকাতর বিষয়গুলো একদিনে সমাধান হয় না। আপনাকে আস্তে আস্তে দুই দেশের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করতে হয়। সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে। ছোটখাটো বিষয়ে যখন বিশ্বাস তৈরি হবে, তখন সেটাকে বড় ইস্যুগুলোর দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’
দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠকটি হবে বৃহস্পতিবার সকালে। তবে সমঝোতা স্মারকগুলোয় স্বাক্ষর করবেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার।
সামনের বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এই বৈঠকের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাবেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আর ভারতের কূটনৈতিক দপ্তরের বরাত দিয়ে সেদেশের সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে, গত একবছর ধরে দুই দেশের সম্পর্কের যে শীতলতা চলছে, সেটি স্বাভাবিক করারও চেষ্টা থাকবে এই বৈঠকে।