খবর৭১ঃ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ একাংশ প্রশাসন তথা আমলাতন্ত্রে ঝুঁকি বাড়ছে। কাঠামোগত শৃঙ্খলা গেছে অনেক আগেই, এখন নানা দল উপদল গোষ্ঠীতে বিভক্ত আমলাতন্ত্র হারাচ্ছে ঐতিহ্যগত শৃঙ্খলা। ক্ষেত্রবিশেষ ঊর্ধ্বতনের আইনানুগ মানবিক অনেক আদেশ নির্দেশ অধস্তনদের দ্বারা উপেক্ষিত হবার নজির তৈরি হচ্ছে। ব্যক্তিগত অসদাচরণ বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনাও বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে গোটা প্রশাসনযন্ত্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশার ক্ষেত্র সংকুচিত হবে, পরিণতিতে প্রশাসন গুরুত্ব হারাবে অনেক ক্ষেত্রে। বর্তমান আমলাতন্ত্রের জন্য বড় ঝুঁকির ক্ষেত্র জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়। খোদ উচ্চপদস্থ আমলাদের মতে, বর্তমান সময়ে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয় কার্যত তলানিতে ঠেকেছে।
বস্তুত, ১৯৮৫ সালের পর প্রশাসনের কাঠামোগত পূর্ণাঙ্গ কোনো সংস্কার হয়নি। এক ধরনের স্বেচ্ছাধীন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রশাসন। পদ নেই তবুও পদোন্নতির ভার বইতে গিয়ে দুমড়েমুচড়ে পড়ছে প্রশাসন। অনেকটা অসহায়ের মতো কর্তৃপক্ষকে পদোন্নতির এই ভার সইতে হচ্ছে। কারণ যোগ্যতা অর্জনকারীদের পদোন্নতিটা তাদের অধিকার। কিন্তু পদ বৃদ্ধি বা সংস্কারের উদ্যোগ না নিয়ে অব্যাহতভাবে অ্যাডহক ভিত্তিতে এ কাজ করতে গিয়ে প্রশাসনের কাঠামোগত শৃঙ্খলা কার্যত অস্তিত্বশূন্য।
চলতি নভেম্বর মাসের তথ্যচিত্র অনুযায়ী ১০৪টি অতিরিক্ত সচিবের মঞ্জুরিকৃত পদের বিপরীতে কর্মকর্তার সংখ্যা ৫৪৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৬৪ জন এবং নারী ৮১ জন। যুগ্ম সচিবের ৪৮৩টি পদের বিপরীতে কর্মকর্তার সংখ্যা ৭৪৩ জন। নারী ১০৫ জন এবং পুরুষ ৬৩৮ জন। উপসচিবের ৮০০ পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ১ হাজার ৬৩৬ জন। এখন আবার ২৭ ব্যাচ কর্মকর্তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সহসাই এ পদে কর্মকর্তার সংখ্যা আরো বাড়বে। উপসচিবের বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে ১ হাজার ২৮৯ জন পুরুষ এবং ৩৪৭ জন নারী রয়েছেন।
অপরদিকে, জ্যেষ্ঠ সহকারীর নির্ধারিত মঞ্জুরিকৃত পদের কোনো অতীত বা বর্তমান হিসাব পাওয়া যায় না। তবে এ পদে বর্তমানে ৪৬০ জন নারী ও ১ হাজার ১১৩ জন পুরুষসহ মোট মোট ১ হাজার ৫৭৩ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। সহকারী সচিবের পদে আছেন ১ হাজার ৪৯০ জন। এর মধ্যে নারী ৪৬৬ জন এবং পুরুষ ১ হাজার ৪৯০ জন।
এ ছাড়া সচিবের পদে আছেন ৭৭ জন এবং গ্রেড-১ (সচিব পদমর্যাদার) পদে নিয়োজিত আছেন ১৬ জন। গ্রেড-১ পদটি নবসৃষ্ট। বিভিন্ন দপ্তর অধিদপ্তর সংস্থা প্রধানের পদটিকে গ্রেড-১ মর্যাদায় উন্নীত করে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সেসব ক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।
দেখা যাচ্ছে এ রকম পরিস্থিতিতে একজন অতিরিক্ত সচিব হয়েও অধস্তন পদের কাজ করতে হচ্ছে তাকে। অনুরূপভাবে সব কয়টি পদের ক্ষেত্রে একই অব্যবস্থাপনা বিরাজমান। এ ছাড়া কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব হয়তো অধস্তন ব্যাচের কিন্তু ঐ মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অধীনের প্রতিষ্ঠান প্রধান ঊর্ধ্বতন ব্যাচের। আবার একই মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অভ্যন্তরেও রয়েছে একই ধরনের বিশৃঙ্খলা। সচিব অধস্তন ব্যাচের, ডেস্কে দায়িত্বরত কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন ব্যাচের। ফলে কে কার নির্দেশ-আদেশ শুনবে?
একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, আগে প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে সিনিয়রদের প্রতি জুনিয়রদের সম্মান দেখানোর যে রেওয়াজ ছিল তা এখন অনেকটাই ফিকে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি ব্যক্তিগত আচার-আচরণ শৃঙ্খলা প্রদর্শনের রীতি এখন অনেকের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মাঠ প্রশাসনের কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়োগ বদলিতেও উপদল, গোষ্ঠী এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এসব সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সমস্যা রয়েছে যা নিকট অতীত থেকে চলে আসছে।
এসব দূর করে একটি জনমুখী কল্যাণকর প্রশাসন তৈরির তাগিদ থেকে সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে সামছুল হক কমিশন একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। এর আগেও একাধিক কমিশন হয়েছে, তারা প্রতিবেদনও দিয়েছে, কিন্তু নানামুখী চাপ আর উদ্যোগের অভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এসব আলোর মুখ দেখেনি ।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সরকারি কর্মচারী আইন হয়েছে। এই আইনের অধীনে বিধিবিধান তৈরির কাজ চলছে। এগুলো বাস্তবায়ন শুরু হলে সবকিছু অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের বিদ্যমান সম্পর্কের বিষয়টি তার মতে বিচ্ছিন্ন। এগুলো মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। এর সার্বিক কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ মো. ইউসুফ হারুন উপরের আলোচনার বিষয়গুলোর সঙ্গে ক্ষেত্রমতে একমত পোষণ করে বলেন, রাজনৈতিক সরকারের সময়ে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক সাবলীল রাখতে হবে। শৃঙ্খলার বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে সে জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। অনেককে শাস্তিও দেওয়া হয়েছে, অনেক অভিযোগ তদন্ত চলছে। কাঠামোগত শৃঙ্খলার প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি সার্বিকভাবে দেখা দরকার। বড় সংস্কার ছাড়া কাঠামোগত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন। তবে তার আশা উপরের কয়েকটি ব্যাচের নিয়োগকৃত বেশি সংখ্যার কর্মকর্তা অবসরে গেলে কাঠামোগত শৃঙ্খলা সুরক্ষা পাবে।