খবর৭১ঃ আজ ৩ নভেম্বর, জেল হত্যা দিবস। পঁচাত্তরের এই দিনে ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় আরেকবার শোকে স্তব্ধ হয়েছিলো বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুহত্যার মাত্র তিন মাসের মধ্যে জেলে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় হত্যা করা হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চার মহানায়ককে। সেদিনের সেই জেলহত্যাকাণ্ডটি কেন সংগঠিত হয়েছিলো তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। জাতিকে চূড়ান্তভাবে নেতৃত্বহীন করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ আর অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাকে ধুয়ে–মুছে খেলার অশুভ উদ্দেশ্যই ছিলো জেল হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে সেদিন কারাগারে প্রবেশের অনুমতি জুটেছিলো সেদিন ঘাতকদের। এই হত্যা কাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচার আর নেপথ্যের কুশীলবদের শনাক্ত করার দাবি, এ নিয়ে লেখা আর বলা হয়েছে অনেক। বলা হবে সামনেও।
আমার এই লেখার প্রেক্ষাপটটি অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। জেলে সেদিন যে চার নেতা শহীদ হয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে এ জাতির শেখার আছে অনেক। প্রথমত যা শেখার তা হচ্ছে– দেশপ্রেম, দ্বিতীয়ত দেশপ্রেম এবং তৃতীয়তও দেশপ্রেম, আর সব শেষে নেতৃত্ব আর নেতার প্রতি অবিচল আস্থা। একাত্তরের মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু এই চার নেতার হাতে যে দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন, একাত্তরের নয়টি মাসে তা তারা পালন করেছিলান পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে। একটি সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে, একটি শপথ নেওয়া সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় আমাদের সশস্ত্র মুক্তির সংগ্রাম যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৬ ডিসেম্বরের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
এই কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ সাধ্য ছিলো না। ছিলো আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রচণ্ড চাপ। পাশাপাশি ছিলো প্রলোভন। কিন্তু না চাপ, না প্রলোভন কোনো কিছুই এই চার মহান নেতাকে তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। একইভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরও তাঁদের প্রয়াত নেতা জাতির পিতার প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলান তাঁরা। একের পর এক নেতা যখন বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বিশ^াসঘাতকতা করেছে, তখন সে পথে হাঁটেননি জাতীয় চার নেতা। মুক্তিযুদ্ধে সময়কার আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বড় কর্তাকে আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে। মোশতাকের সাথে শপথ পড়েছিলো বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অনেক মন্ত্রী। ব্যতিক্রম ছিলেন এই চারজন। সামান্য আপোস করলেই তারা হতে পারতেন আবারও উপ–রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। কিন্তু সে পথে না গিয়ে তারা বেছে নিয়েছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর পথ।
বঙ্গবন্ধু যেমন তাঁর দেশের মানুষের স্বার্থের সাথে আপোস করেননি, জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন কেন তিনি জাতির পিতা, তেমনি এই চার মহান নেতা খুনির সাথে আপোস না করে জাতি এবং জাতির পিতার প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা, সোনার অক্ষরে লিখে গেছেন। আজকের বাস্তবতায় চারিদিকে যখন শুধু চাই আর চাই, কী পেলাম কী পেলাম না, এ নিয়ে শুধুই হাহাকার, তখন চার নেতার জীবন এবং তাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের কাছে শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয় হয়ে থাকুক এবারের ৩ নভেম্বর, এটাই প্রত্যাশা। যদি চার নেতার আদর্শকে আমরা ন্যূনতমও ধারণ করতে পারি, তাহলে অনেক না পাওয়ার বেদনা ভুলে বরং অনেক পাওয়ার আনন্দে বিভোর হতে পারবো আমরা।