পেশাদার পর্ষদ ছাড়া ব্যাংক ভালো চলতে পারে না

0
344
ব্যাংক

খবর৭১ঃ
যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং পেশাদার পরিচালনা পর্ষদ ছাড়া ব্যাংক ভালো চলতে পারে না। একইসঙ্গে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও কম নয়; বরং ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে ব্যাংকের অগ্রগতি ও অবনতি। তবে উভয়ের মধ্যে বোঝাপড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ সবই বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের রয়েছে। সম্প্রতি সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। এ সময় ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নানা দুর্বলতা নিয়েও খোলামেলা কথা বলেন তিনি।

অগ্রণী ব্যাংকের নানা অগ্রগতির বিষয়ে ড. জায়েদ বখত বলেন, প্রবাসী আয়ের টাকা ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা না থাকলে আমদানি-রফতানি খাতের ভালো গ্রাহক পাওয়া যায় না। ফলে বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হয়। এগুলো বিবেচনা করে অনেক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে রেমিটেন্স আসা থেকে বিতরণ পর্যন্ত যত বাধা ছিল সব দূর করা হয়েছে। সে কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মধ্যে রেমিটেন্সের শীর্ষে অগ্রণী ব্যাংক। বিদায়ী বছরে ব্যাংকটির মাধ্যমে ১৪ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছে। বর্তমানে প্রবাসী আয়ের গতি আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। শুধু রেমিটেন্স নয়, আমদানি-রফতানিতেও শীর্ষে অগ্রণী ব্যাংক। কয়েকটি সূচকে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে জায়েদ বখত বলেন, ২০১৯ সালে ৩৮ হাজার ৮৪১ কোটি টাকার আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের সেরা হয়েছে অগ্রণী ব্যাংক।

ব্যাংকটির আমদানি প্রবৃদ্ধি ৬৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ সময় রূপালী ব্যাংকের আমদানি প্রবৃদ্ধি ৩৫ দশমিক ১০ শতাংশ, সোনালী ব্যাংকের শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ এবং জনতা ব্যাংকের মাইনাস ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। একইভাবে ২০১৯ সালে ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকার রফতানি করেছে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির রফতানি প্রবৃদ্ধি ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ সময় রূপালী ব্যাংকের রফতানি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের মাইনাস ১৮ দশমিক শূন্য শতাংশ এবং সোনালী ব্যাংকের মাইনাস ২১ দশমিক শূন্য শতাংশ। তিনি বলেন, আমানত প্রবৃদ্ধি, নিট সুদ আয়, পরিচালন মুনাফাসহ আরও অনেক সূচক বিবেচনায় প্রথম সারিতে অবস্থান করছে অগ্রণী ব্যাংক।

ঋণ-আমানত রেশিও (এডিআর) প্রসঙ্গে জায়েদ বখত বলেন, এডিআরের দিক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির এডিআর ৬৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া জনতা ব্যাংকের ৭৯ দশমিক ৩০ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ৭৪ শতাংশ এবং সোনালী ব্যাংকের ৪৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। ছয় বছর আগে যখন আমি চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করি তখন অগ্রণীর এডিআর ছিল ৫৪ শতাংশ। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ৬৭ শতাংশে উন্নীত করা হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের জুনে তা ৬৩ শতাংশে অবস্থান করে। আমানত, রেমিটেন্স ও রফতানিতে শক্তিশালী অবস্থান থাকায় অগ্রণী ব্যাংকের নতুন ঋণ দেয়ার সক্ষমতা অনেকগুণ বেড়েছে। তবে নতুন ঋণ বিতরণে যাচাই-বাছাইকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছি। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের পর যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে সেগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশের নিচে।

সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দেয়ার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিচ্ছি। একইসঙ্গে নতুন করে কেউ যেন খেলাপি না হয় সেদিকে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। নতুন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে কি না, সঠিক ব্যক্তি ঋণ পেয়েছে কি না এবং অর্থ পাচারের সুযোগ থাকছে কি না, টাকাটা ফেরত পাওয়া যাবে কি না এবং জামানত পর্যাপ্ত রয়েছে কি না-এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের সার্বিক খেলাপি ঋণের হার ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৪ সালে যখন আমি চেয়ারম্যান হয়ে আসি তখন খেলাপির এই হার ছিল ২৯ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে কমাতে কমাতে এখন ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এটাই সর্বনিম্ন।

পুরো ব্যাংকিং খাতে বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে জায়েদ বখত বলেন, ৯৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি, এটা পুঞ্জীভূত। একদিনে তৈরি হয়নি। কিছু ব্যাংক দু-একজন গ্রাহকের কারণে ডুবে গেছে। বিশেষ করে জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ, এনন টেক্স, ক্রিসেন্ট লেদারের নানা অনিয়মের জন্য তাদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। কিন্তু একটা সময় ভালো ছিল ব্যাংকটি। অগ্রণী ব্যাংকে এখন পর্যন্ত এ ধরনের বড় কোনো অনিয়ম হয়নি। এদিক থেকে আমরা নিরাপদ। তিনি বলেন, একটা সময় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে ধরা খেয়েছে সব ব্যাংক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রফতানিতে অবাধ সুযোগ দেয়া হয়। সে সময় বিপুল অঙ্কের অর্থায়নে অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। সরকারি সবুজ সংকেতের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল।

এই অর্থ দিয়ে অনেকে জমিজমা কিনেছে, শেয়ারমার্কেটে খাটিয়েছে। পরে জমি ও শেয়ারের দাম কমেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামও কমেছে। যে পণ্য আমদানি করেছে সে পণ্যটাও বিক্রি করতে পারেনি। ফলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যাংকগুলোও ডুবেছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ কয়েকটি বড় ঘটনা রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় একটা অজানা সাইড স্টোরি রয়েছে। এই মুহূর্তে অগ্রণী ব্যাংক সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। ড. জায়েদ বখত বলেন, বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে দু’ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিছু গ্রাহক আছেন যাদেরকে প্রকল্প অনুমোদনের আগেই অর্থায়ন করতে পারি। তারা কখনও বিশ্বাসের অমর্যাদা করেন না। আর যারা উদ্যোগী এবং পরিশ্রমী তাদের ঋণ কখনও বিফল হয় না। বিপরীতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিছু গ্রাহক আছেন যারা একের পর এক ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে থাকেন। কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গায় ফোকাস দিতে পারেন না। এই শ্রেণির ব্যবসায়ীরা নিজেরাও ডোবে ব্যাংককেও ডোবায়। তবে বিচক্ষণতার সঙ্গে বিনিয়োগ করলে বিপদের আশঙ্কা কম। তিনি বলেন, আমি আসার পর প্রায় ডজন খানেক বড় এবং ভালো শিল্পগ্রুপকে অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছি। ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকের প্রতিটি পর্যায়েই অনিয়ম বন্ধের সংকেত বেজে ওঠা উচিত। প্রথমে শাখা পর্যায়ে পরে প্রধান কার্যালয়-কোথাও-না-কোথাও দুর্নীতিবিরোধী সংকেত বেজে ওঠা প্রয়োজন। হলমার্কের সময় সব সংকেত বন্ধ ছিল। সে কারণে ক্ষতিও হয়েছে অনেক। সেই দুর্ঘটনার পর সবাই অত্যন্ত সতর্ক হয়ে গেছে।

তাই এ ধরনের দুর্নীতি এখন আর ঘটে না। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের বিষয়ে ড. জায়েদ বখত বলেন, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে ঋণ অনিয়ম হয়েছে তার বিরুদ্ধে যথাসময়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ব্যাংকিং খাতেও অনিয়মের সে খারাপ ঢেউ আছড়ে পড়েছে। মাত্র দু-একজন লোক কীভাবে এতগুলো টাকা আত্মসাৎ করতে পারে, বিষয়টা পুরো কল্পকাহিনীর মতোই। এটা অবশ্যই আর্থিক খাতের একটি বড় ক্ষত। এখান থেকে সহসা বেরিয়ে আসা দুরূহ। আশা করি, সরকার অপরাধীদের চিহ্নিত করে বের করবেন এবং টাকাগুলো আদায় করার চেষ্টা করবেন। দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পুরো খাতেই আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে খাতটির প্রতি আস্থাটা ফিরে আসে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে অভিনব প্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে হবে।

আইন-আদালত এবং ভয় দেখিয়ে যেমন টাকা আদায় করা যাবে না, তেমনি একের পর এক সুবিধা দিয়ে পিঠে হাত বুলালেও খেলাপি ঋণ আদায় হবে না। দুটির ‘কম্বিনেশন’ দরকার। ঋণখেলাপিদের একটি বড় অংশ টাকা ফেরত দিতে চায়। বিভিন্ন কারণে তারা এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছেন যেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারছেন না। তবে অপর একটি অংশ আছে যারা আত্মসাতের জন্য ঋণ নিয়েছিল। এরা টাকা ফেরত দিতে চায় না। এ ধরনের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফলোআপ এবং মনিটরিং আরও জোরদার করা উচিত। নিজের ব্যাংকের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ড. জায়েদ বখত বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ এবং ম্যানেজমেন্টের মধ্যে খুবই ভালো বোঝাপড়া রয়েছে। ব্যাংকের উন্নতির জন্য এ ধরনের পরিবেশ বজায় থাকা দরকার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here