খবর৭১ঃ
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা সমীরণ চন্দ্র দে। সম্প্রতি বাসা বদল করেছেন উত্তরায়। আগের বাসার প্রিপেইড মিটারে একবার ১ হাজার টাকা রিচার্জ করলে তিন মাসের রান্নার জ্বালানি অনায়াসে পেয়ে যেতেন তিনি। আর নতুন বাসায় পোস্টপেইড মিটারের কারণে মাস শেষে বিল দেন ৯৭৫ টাকা। অর্থাৎ বর্তমানের এক মাসের গ্যাস বিলের টাকা দিয়ে আগে প্রায় তিন মাস চলে যেত তার চার সদস্যের পরিবারের।
রাজধানীর আরেক এলাকা মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফাতেমা বানু চলতি বছরেই বাসাবদল করেছেন রামপুরায়। আগের বাসায় মাসিক ৯৭৫ টাকা গ্যাস বিল দিতে হলেও বর্তমান বাসায় ১ হাজার ২০০ টাকার রিচার্জে প্রায় তিন মাস চলে যায় ৬ সদস্যের পরিবারটির।
দেশের আবাসিক খাতের পোস্টপেইড গ্রাহকরা কী পরিমাণ বঞ্চনার শিকার তা এ দুই গ্রাহকের গ্যাস ব্যবহার এবং বিল পরিশোধের চিত্রেই ফুটে উঠে। গড়পড়তায় প্রতি মাসে পোস্টপেইড গ্রাহকদের কাছ থেকে তাদের ব্যবহারের চেয়ে বেশি বিল আদায় করছে গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো। বছরের পর বছর ধরে এ বঞ্চনা বৈষম্য চলে আসলেও এর প্রতিকার হচ্ছে না। সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা গেলে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভব। কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে এ কার্যক্রম চললেও আবাসিক খাতের ৪৩ লাখ গ্রাহকের সকলকে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে পারেনি সরকারি কোম্পানিগুলো।
দেশে গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণ করে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সর্বশেষ গত বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া মূল্যহার অনুযায়ী আবাসিক খাতের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১২ টাকা ৬০ পয়সা। সঞ্চালন ও বিতরণ মাশুল এবং মূল্য সংযোজন কর- ভ্যাটসহ এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও মূল্যহারে গ্যাস উত্পাদন খরচের বাইরে এলএনজি চার্জ, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল এবং জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলে দেওয়া অর্থও ধরা হয়েছে। অন্যদিকে দুই চুলার এক গ্রাহকের জন্য মাসিক বিল ধার্য করা হয় ৯৭৫ টাকা। অর্থাত্ প্রিপেইড গ্রাহকের সমান্তরালে বিবেচনা করলে এই পোস্টপেইড গ্রাহকদের প্রত্যেকে প্রতি মাসে ৭৭ দশমিক ৩৮ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা এর অর্ধেকের চেয়েও কম ব্যবহার করেন বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ঢাকায় শতাধিক আবাসিক গ্যাস গ্রাহকের মাসিক বিল বিশ্লেষণেও এ মতের সত্যতা মেলে। এক জন পোস্টপেইড গ্রাহকের এক মাসের বিল দিয়ে এক জন প্রিপেইড গ্রাহক দুই থেকে তিন মাসের গ্যাস বিল পরিশোধ করতে পারেন।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ছয়টি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানির আওতায় বর্তমানে মোট আবাসিক গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ। এদের মধ্যে প্রিপেইড সংযোগ পেয়েছেন প্রায় ৩ লাখ গ্রাহক। অর্থাৎ প্রায় ৪০ লাখ গ্রাহক পোস্টপেইড বিল পরিশোধ করেন। এদের মধ্যে সিংহভাগই যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছেন তারচেয়ে বেশি বিল পরিশোধ করছেন।
গত জুলাই মাসে আবাসিক পর্যায়ে খোলাবাজার হতে পিপেইড/ স্মার্ট গ্যাস মিটার ক্রয় ও স্থাপন নীতিমালা-২০১৯ প্রসঙ্গে বিইআরসি সচিব রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে দেওয়া হয়। ঐ চিঠিতে জানানো হয়, মিটারবিহীন গৃহস্থালি গ্রাহকদের জন্য প্রিপেইড গ্যাস স্থাপন কার্যক্রম সম্পন্ন করলে প্রতি চুলায় ৩৩ ঘনমিটার অর্থাত্ বছরে প্রায় ৫৩ বিসিএফ (বিলিয়ন কিউবিক ফিট) গ্যাস সাশ্রয় হবে। এর বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। তবে জ্বালানি বিভাগের এক সাবেক অতিরিক্ত সচিব বলেন, এ অপচয় আরো কমিয়ে সাশ্রয় আরো বাড়ানো যাবে। কিন্তু পোস্টপেইড গ্রাহকদের থেকে বেঁচে যাওয়া গ্যাসকে পুঁজি করে বিশাল সংখ্যক অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে রেখেছে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কয়েকটি শক্তিশালী চক্র। তাই তারা প্রিপেইড মিটার বাস্তবায়ন করতে নানাভাবে বাধা দেয়।
বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, সরকার সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে নির্দেশনা দিয়েছে এবং এ সংক্রান্ত নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিতরণ কোম্পানিগুলোর। তারা সেটি করতে গড়িমসি করছে, অযথা দেরি করছে। আমরা নিয়মিত বিরতিতে কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছি।
ছয়টি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাসিক গ্রাহক তিতাসের- ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯। এর মধ্যে ২ লাখ সাড়ে ১২ হাজার গ্রাহক প্রিপেইড মিটার পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল মামুন বলেন, সরকার সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এ খাতে এখন স্বাগত জানিয়েছে। শিগিগরই যেন ৮ লাখ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাকি ২০ লাখ গ্রাহকের মিটারের জন্য অর্থ সংস্থানের চেষ্টা চলছে। দুর্নীতিমুক্ত এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রিপেইড মিটার খুব জরুরি। সে গুরুত্ব বুঝতে পেরে আমরাও বুঝতে পেরেছি। যত দ্রুত সম্ভব সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হবে।