খবর৭১ঃ
পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ করে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় একদিকে যেমন দেশের পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে অন্যদিকে ভারতের সীমান্তে আটকা পড়েছে ব্যবসায়ীদের আমদানি করা শত শত ট্রাকভর্তি পেঁয়াজ। এসব পেঁয়াজ অতি দ্রুত খালাস করতে না পারলে তা পচে নষ্ট হয়ে যাবে।
রপ্তানি বন্ধের পর গত সোমবার থেকে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর, যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর ও দর্শনা আন্তর্জাতিক রেলবন্দর দিয়ে কোনো পেঁয়াজ দেশে ঢোকেনি। অথচ এসব সীমান্তের ভারতের অংশে আটকে আছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমদানি করা পেঁয়াজ। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এলসির মাধ্যমে আমদানি করা এসব পেঁয়াজ রপ্তানির বন্ধের আগেই কেনা হয়েছে। কিন্তু এখন রপ্তানি বন্ধের অজুহাতে এসব পেঁয়াজ ভারত বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে না।
হাকিমপুর (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জাহিদুল ইসলাম জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা পুনরায় রপ্তানির আশ্বাস দিলেও গতকাল বুধবার পর্যন্ত সীমান্তে আটকে থাকা পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাকগুলো হিলি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা।
গত সোমবার ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে সংকটের কারণে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে শুধু দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের ভারত অংশেই কমপক্ষে ২৫০ থেকে ৩০০ পেঁয়াজ বোঝাই ভারতীয় ট্রাক বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় আটকা পড়ে। বেনাপোল সীমান্তে আটকা পড়েছে আরো ৩০০ ট্রাক। প্রায় একই অবস্থা অন্য বন্দরগুলোতেও।
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ ভারতের ব্যবসায়ীদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, গত রবিবার ২০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য টেন্ডার করা হয়েছিল। আশা করছি, সেই পেঁয়াজ ভারত সরকার বাংলাদেশে রপ্তানির অনুমতি দেবে। তা না হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, এক থেকে দুই দিনের মধ্যে বর্ডারে যেগুলো আটকা আছে সে বিষয়ে সমস্যার সমাধান হবে।
প্রয়োজনের বেশি পেঁয়াজ না কেনার পরামর্শ বাণিজ্যমন্ত্রীর
ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় দেশের পেঁয়াজের বাজারে যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে তা এখনো কমেনি। অধিকাংশ ক্রেতাই দাম আরো বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ কিনছেন। গতকালও রাজধানীর বাজারে দেশি পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১২০ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়।
এদিকে দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজের মজুত রয়েছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ক্রেতাদের প্রয়োজনের বেশি পেঁয়াজ না কেনার পরামর্শ দিয়েছেন। গতকাল সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স রুমে পেঁয়াজের মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে টিপু মুনশি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম ভারত পেঁয়াজের দাম বাড়াবে, ভাবিনি রপ্তানি বন্ধ করে দেবে। কিন্তু হঠাত্ করে বন্ধ করে দিল। যার ফলে আমরা একটা চাপে পড়েছি। পেঁয়াজ নিয়ে কোনো রাজনীতি আছে কি না, জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমি বাণিজ্যমন্ত্রী, বাণিজ্য বুঝি। পিছনে কোনো রাজনীতি আছে কি না, সে উত্তর আমি দিতে পারব না।’
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি)-র মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেঁয়াজ কিনবেন না। পেঁয়াজ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, তুরস্ক ও মিশর থেকে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে, অল্পদিনের মধ্যে এগুলো দেশে পৌঁছাবে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের আগেই আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে এগুলো ক্রয় করা হয়েছিল।
টিসিবি এবার বড় ধরনের পেঁয়াজের মজুত গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ই-কমার্সের মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে টিসিবি। আগামী বছর মার্চ পর্যন্ত টিসিবি পেঁয়াজ বিক্রি করবে বলে তিনি জানান।
টিপু মুনশি বলেন, পেঁয়াজের মজুত, সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন বাজার মনিটরিং জোরদার করেছে। তিনি বলেন, পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে কূটনীতিক মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করছি, একমাসের মধ্যে অবস্থা স্বাভাবিক হবে।
কলকাতা থেকে তারিক হাসান জানান, ভারতে রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের পর বেনাপোল সীমান্তে আটকে রয়েছে পেঁয়াজবোঝাই ৩০০ ট্রাক। প্রতিটি ট্রাকে ২০ থেকে ৩০ টন পেঁয়াজ রয়েছে। সব মিলিয়ে আটকে রয়েছে সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টন। ভারত সরকারের বিশেষ অনুমোদন পেলে এই বিশাল পরিমাণ পেঁয়াজ বাংলাদেশে ঢুকতে পারবে।
কলকাতার বাংলাদেশ মিশন সূত্রে খবর, এই বিরাট পরিমাণ পেঁয়াজ যাতে বাংলাদেশে যেতে পারে তার জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড অনুমোদন দিলেই পেঁয়াজবোঝাই ট্রাকগুলো বাংলাদেশে যেতে পারবে। অন্তত দুই দিন সময় লাগবে এই ৩০০ ট্রাক পেঁয়াজ বাংলাদেশে ঢুকতে। তবে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ সংক্রান্ত অনুমতি পাওয়া যায়নি।
দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বাজারে ২৫ থেকে ৩০ রুপি প্রতি কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল। হঠাত্ই দাম চড়তে শুরু করে। খোলা বাজারে দাম পৌঁছে যায় ৪০ রুপি প্রতি কেজি। এরই মধ্যে ভারতের প্রধান পেঁয়াজ উত্পাদক রাজ্য মহারাষ্ট্রে পাইকারি দর বাড়তে শুরু করে। পরিস্থিতি বুঝে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী পেঁয়াজ মজুত করতে শুরু করেন। কলকাতার এক পাইকারি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে পেঁয়াজের দর বাড়তে শুরু করেছে। তার কারণেই রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত। এদিকে, রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গের বাজারগুলোতে পেঁয়াজের দামে কোনো হেরফের হয়নি।