খবর৭১ঃ কোভিডকালীন আমাদের এই নব্য স্বাভাবিকতায় অনেক হিসাব-নিকাশ-ই আমরা নতুন করে করছি। রাতারাতি কীভাবে যেন বদলে গেল আমাদের আশপাশের সবকিছু সহসাই কোনো কিছু ঠিকঠাক মতো বুঝে ওঠার আগেই। এখনও মনে হয় এইতো সেদিন ঢাকা ক্লাবে বর্ষবরণে মেতে ছিলাম। অথচ বাস্তবে ‘কোভিড কোভিড’ করতে করতে আবারও দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার ঝুলানোর সময় সমাগতপ্রায়।
এই আগস্টের ক্যালেন্ডারে বাঙালির জন্য উল্লেখযোগ্য তারিখ বেশ কয়েকটি। পনের, সতের, একুশ- সবগুলোই বেদনাবিধুর। আর যে কয়টি আনন্দের, যেমন পাঁচ কিংবা তেরো, শেখ কামাল আর বঙ্গমাতার জন্মদিন, শোকের আবছা ছায়া সেখানটাতেও। এবারের কোভিডকালীন নব্য স্বাভাবিকতায় এই ক্যালেন্ডারে যুক্ত হয়েছে এমন আরেকটি তারিখ, মাসের শেষের দিনটি, একত্রিশ আগস্ট। দিনটি আনন্দের। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শক্তি চীন এইদিন আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু এখানেও মিশে আছে কিছুটা গ্লানি। বহুল প্রত্যাশিত এই চীনা স্বীকৃতিটা বাংলাদেশের কপালে জুটেছিল পঁচাত্তরে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের ষোলতম দিনের মাথায়।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানকারী রাষ্ট্রগুলোকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। একগুচ্ছ রাষ্ট্র আছে যারা আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল পঁচাত্তরের আগে, যার পুরোভাগে আছে ভারত আর ভুটান। আর আরেকগুচ্ছ রাষ্ট্র আছে যাদের স্বীকৃতি আমরা পেয়েছিলাম পঁচাত্তরের পরে। কাদের সাথে আমাদের সম্পর্কটা নাড়ির আর কাদের সাথে নয়, এ জিনিসটা পঁচাত্তরের পনের আগস্টের আগে পরে মোটা দাগে স্পষ্ট হয়ে যায়, দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মাথায় তাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় সমাহিত করার আগেই পাকিস্তান স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে, আগস্টের ষোল তারিখ। পাশাপাশি ভুট্টো খয়রাতি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টন গম আর দেড় কোটি টন মোটা কাপড়। ভুট্টো তার বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশকে’ স্বীকৃতি দেবার জন্য। ভুট্টোর সেই আহ্বানে যারা সাড়া দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম চীন।
হঠাৎ এ প্রসঙ্গে লেখার অবতারণার প্রেক্ষাপটটা অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। আমরা কেউ-ই বাস্তবতা বর্জিত নই। আজকের রূপান্তরিত পৃথিবীতে চীন নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক পরাশক্তি। একাত্তরে তারা পাকিস্তানের পক্ষে যতই সাফাই গেয়ে থাকুক না কেন, স্বাধীনতার পর জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদভুক্তি আর হালের রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনায় তারা দফায় দফায় ভেটো যতই প্রয়োগ করুক না কেন, উন্নয়নের জোয়ারে ঠিকঠাক মতো সাঁতার কাটতে হলে তাদেরকে আমাদের পাশে চাই, সেটা না বোঝার মতো অর্বাচীন আমরা কেউ-ই না।
সম্ভবত ২০১৬ তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধের বিচার চালিয়ে যাবে আর পাকিস্তান চালিয়ে যাবে তাদের জন্য তাদের মায়াকান্না। আর কূটনৈতিক সম্পর্কটা কূটনীতির জায়গায় থেকে যাবে। এটাই বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রজ্ঞা আর দর্শন, সম্পর্কটা সম্পর্কের জায়গায় আর আদর্শটা আদর্শের।
নব্য স্বাভাবিকতার আজকের প্রেক্ষাপটে কারও কারও হঠাৎ উচ্ছ্বাসে মনে হয় আমরা কেউ কেউ বোধহয় উন্নয়নের উম্মাদনায় আদর্শ আর উন্নয়নকে গুলিয়ে গুবলেট করে ফেলছি। সমস্যাটা এখানেই। উন্নয়ন আর ব্যবসাকে জায়গা করে দিতে গিয়ে ইতিহাস আর শিকড়ের জলাঞ্জলি দেয়ার ইতিহাস কিন্তু একদম-ই সুখকর নয়। পুঁজিবাদী আমেরিকাকে পরাজিত করার পর সমাজতন্ত্রী ভিয়েতনামে বহিঃশক্তির প্রথম যে আগ্রাসনের গল্প শুনে সেই ছোট বেলা থেকে আজ পঞ্চাশে পা দিয়েছি আর এই পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে হালের শ্রীলংকার বা জিবুতিতে যা দেখছি তা আমাদের এই শিক্ষাটাই দেয়।