সমন্বয়হীন স্বাস্থ্য খাত

0
374
সমন্বয়হীন স্বাস্থ্য খাত

খবর৭১ঃ

সমন্বয়হীনতার কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি আসছে না। স্বাস্থ্য প্রশাসনের মাঠ পর্যায় থেকে শীর্ষ পর্যন্ত সমন্বয়ের বড় অভাব রয়েছে। মন্ত্রীর সঙ্গে সচিবের সমন্বয় নেই। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অধিদপ্তরের সমন্বয় নেই। করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের হাসপাতালের আশপাশের হোটেলে রাখার ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিও জানেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এদিকে করোনার দোহাই দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে হচ্ছে না সভা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটিতে ডাকা হয় না স্থানীয় সংসদ সদস্যদের। এ ধরনের কমিটির কথা জানেন না অনেক এমপি, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একতরফা। আবার অনেকে জানলেও বছরের দু-একবার নামেমাত্র মিটিং করেন। তাদের অধিকাংশ সুপারিশের বাস্তবায়ন হয় না। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা নাজুক, এবারের করোনা এসে সবার চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এ খাতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে কিন্তু সে তুলনায় ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। সেবা নিশ্চিত হয়নি সাধারণ মানুষের। অনিয়ন্ত্রিত লুটপাট, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে এমনটি হয়েছে। চিকিত্সাসেবায় গোড়ায় গলদের বিষয়টি করোনাকালেই প্রকাশ্যে চলে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাজেটে অর্থ বাড়ালেই রোগ সারবে না। দরকার সুস্থ ব্যবস্থাপনা। হঠাত্ করে করোনার বুলেটিন প্রচার বন্ধ করা, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাত্ এক শ্রেণির আমলারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে।

কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর আশপাশে হোটেলে থেকে করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে আসছিলেন ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। এই ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মাঝে। যে কোনো সময় তারা কর্মবিরতিসহ কঠোর আন্দোলনে নামতে পারেন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদ (স্বাচিপ) এ ব্যাপারে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এক শ্রেণির আমলা এমন কাজ করছেন। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি।

কিছুদিন পর আবার বলা হচ্ছে, তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক। স্বাস্থ্যে অনেক কমিটি থাকলেও তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। এসব কমিটির কাজে গতি আনার পরিবর্তে গত ২৬ জুলাই হাসপাতালের অনিয়ম তদারকিতে অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়ে হাসপাতালগুলোর দেখভালের জন্য একটি ভিজিলেন্স টিম আছে। এর সভাপতি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। আর সদস্য সচিব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক। তাদের কাজ নিয়মিত বিভিন্ন হাসপাতালে যাবে, ডাক্তারদের উপস্থিতি ও সেবা মনিটরিং করবে। কিন্তু বাস্তবে এ কমিটির কার্যক্রম চোখে পড়ে না। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটি আছে। পদাধিকার পদে এই কমিটির সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য।

এই কমিটি নিয়মিত মিটিং করে সুপারিশগুলো সিভিল সার্জনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা। জেলা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটি আছে জেলা পর্যায়ে। এই কমিটির প্রধানও এমপিরা। বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ও আছে। বেসরকারি ক্লিনিক দেখভাল করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কমিটি আছে। কিন্তু কোনো কমিটিই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। বাধ্য হয়ে মোবাইল কোর্ট যায় হাসপাতালে, জেল-জরিমানা করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এতগুলো কমিটি থাকতে টাস্কফোর্স গঠন করার প্রয়োজন কী? যেসব কমিটি আছে সেগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে নতুন কোনো কমিটির প্রয়োজন নেই। টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের দুরবস্থা প্রমাণিত হয়েছে। এই টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মালিকগণও ক্ষুব্ধ। তারা বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করলে তারা হাসপাতালের চিকিত্সা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। নন-মেডিক্যাল পারসনদের এই অধিদপ্তরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে নার্সিং সেক্টরে চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। প্রশাসনিক ও নার্সিং কলেজে নার্সদের দীর্ঘদিন পদোন্নতি নেই। জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নার্সদের পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। নার্সিং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যাদের চাকরির বয়স চার বছর কিংবা দুই বছর রয়েছে এবং যারা সদ্য পাস করা তাদের এক সঙ্গে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ উপেক্ষা করে নিয়োগ বিধি পরিবর্তন করেছে। আর তা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে নার্সিং অধিদপ্তর। এতে নার্সরা ক্ষুব্ধ।

অতিসম্প্রতি স্বাস্থ্য সচিব শিক্ষা আলি নূরকে বিষয়টি অবিহিত করা হলে তিনি যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্সিং শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশনা দেন। ফলে নার্সিং অধিদপ্তর থেকে শিক্ষক নিয়োগের বিতর্কিত প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। নার্সদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। অনভিজ্ঞদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি ওঠে। কয়েক শ সিনিয়র স্টাফ নার্স আছেন যারা এমএস, এমপিএইচসহ দেশ-বিদেশের উচ্চতর ডিগ্রিধারী। পদবিন্যাস না করার কারণে তারা সিনিয়র স্টাফ নার্সই থেকে যাচ্ছেন। জানা গেছে, এক শ্রেণির আমলা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। তাই তারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে। সরকারের বিরুদ্ধে ডাক্তার-নার্সদের উসকে দিতে চায় তারা।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অনেক কমিটি আছে। এসব কমিটি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন সাধিত হবে। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে এমপিরা যদি নিয়মিত মিটিং করে সুপারিশ পাঠান এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি আসবে। তবে অনেক এমপি এগুলো করেন না। এ ব্যাপারে সীতাকুন্ড-৪ আসনের এমপি আলহাজ দিদারুল আলম বলেন, জেলা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটিতে তিনি আছেন। কিন্তু সেখানে তাকে ডাকা হয় না। করোনার মধ্যে একবার ডাকা হয়েছিল।

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, নিয়মনীতি না মানলে অব্যবস্থাপনা হবেই। যার যে কাজ তাকে দিয়ে সেই কাজ করানো উচিত। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকলে দেশব্যাপী তার প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল জানান, স্বাস্থ্যে মন্ত্রি-সচিবের দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। অনেকটা আমলাতান্ত্রিক আগ্রাসন চলছে। এক শ্রেণির আমলা ঠান্ডা মাথায় সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সমন্বয়হীনতার কর্মকাণ্ড ষড়যন্ত্রের অংশ। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে নিয়োজিত ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে যে কোনো মুহূর্তে ডাক্তাররা আন্দোলনে যেতে পারেন। কারণ তাদের পরিবারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার-নার্সদের সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে আমলাদের একটি অংশ কাজ করছে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।

বিভিন্ন জেলায় নিয়মিত হচ্ছে না স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটির সভা খুলনা অফিস জানায়, খুলনায় দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটির’ সভা বন্ধ রয়েছে। ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত পাঁচ মাস ধরে এই সভা বন্ধ রয়েছে। ফলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে না।

সিলেট অফিস জানায়, সিলেট জেলা, উপজেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটির সভাপতি নিজ নিজ আসনের সংসদ সদস্যগণ। কিন্তু তারা নিয়মিত সভায় উপস্থিত হতে পারেন না। সিলেটের সিভিল সার্জন প্রেমানন্দন মন্ডল জানান, ঐ কমিটির সভায় সংসদ সদস্যগণ উপস্থিত না থাকলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান উপস্থিত থাকেন। তিনি বলেন, বর্তমান করেনা পরিস্থিতিতে অনেক সময় ভার্চুয়াল সভা হয়ে থাকে।

কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, প্রতি মাসে জেলা-উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কমিটির সভা করার নিয়ম থাকলেও অনেক সময় তিন-চার মাসেও তা হয় না। কুমিল্লা সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, ‘বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে নিয়মিত সভা করা যাচ্ছে না, তবে স্বাস্থ্যসেবার নানা বিষয়ে উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে ভার্চুয়াল সভা হচ্ছে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here