খবর৭১ঃ
দক্ষ জনশক্তির অভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনা শনাক্তের পরীক্ষা বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে। চালু ল্যাবগুলো ঠিকমতো চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
রাজধানীর ২১টি ল্যাবের ৭টিতেই নিয়মিত পরীক্ষা বন্ধ। ঢাকার বাইরেও একাধিক ল্যাবে প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না।
দেশে মোট ৪২টি ল্যাবের মধ্যে ১২ থেকে ১৫টির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে দিনে ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। লোকবল সংকটের সঙ্গে পরিচালনায় সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন।
তারা বলেন, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করার জন্য আরটিপিসিআর (রিয়েলটাইম পলিমার চেইন রিএ্যাকশন) মেশিন ব্যবহার করা হয়।
এসব মেশিন পরিচালনায় ভাইরোলজিস্ট এবং মাইক্রোবায়োলজিস্ট প্রয়োজন। পাশাপাশি নমুনা সংগ্রহসহ পরীক্ষার কাজে সার্বিক সহযোগিতার জন্য দরকার দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট।
কিন্তু দেশে এ ধরনের লোকবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার পরীক্ষা বাড়াতে দেশে ৪২টি ল্যাব স্থাপন করেছে।
কিন্তু সেই ল্যাবগুলো চালানোর প্রয়োজনীয় লোকবল রাতারাতি তৈরি সম্ভব নয়। এ অবস্থায় এক বা দুই জনের ওপর ল্যাবের দায়িত্ব থাকায় চাপ বেড়েছে।
তারা প্রাথম দিকে কাজ করতে পারলেও এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে রোস্টার করে নিলে কাজের সুবিধা হতো, চাপ কমত। কিন্তু এতদিনেও তা করা হয়নি। এছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটিও এর সঙ্গে যোগ হয়ে পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছে।
এ প্রসঙ্গে ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, উপযুক্ত লোকবলের অভাব রয়েছে। তাই কয়েকটি ল্যাব নিয়মিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। খুলনা, জামালপুর, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে একজন করে ভাইরোলজিস্ট আছেন। রাতারাতি এ ধরনের জনবল গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
তাই ল্যাব পরিচালনায় ভাইরোলজিস্টদের পাশাপাশি মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং বায়োকেমিস্টদের কাজে লাগাতে হবে। সবার সমন্বয়ে রোস্টার করে দায়িত্ব বণ্টন করতে হবে। এক রোস্টার কাজ করলে পরবর্তী কমপক্ষে দুই রোস্টার তাকে বিশ্রাম দিতে হবে। তাহলে ল্যাবগুলো চালানো সম্ভব হবে।
জানা গেছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭ মে থেকে পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। এয়ার সার্কুলেশনজনিত ত্রুটির কারণে পুরো ল্যাবে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, নিপসম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বিএসএমএমইউ, আইসিডিডিআরবিসহ ৭ প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত করোনা পরীক্ষা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষানিরীক্ষা করা। ভাইরোলজিস্ট, পিসিআর মেশিন এবং পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাবে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাইরোলজির এক অধ্যাপক যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশে ভাইরোলজিস্ট আছে মাত্র ৬৪ জন। এর মধ্যে অনেকে বৃদ্ধ এবং সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নেই।
অনেকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাছাড়া ঢাকার বাইরের অনেক মেডিকেল কলেজে ভাইরোলজি বিভাগই নেই। ল্যাব পরিচালনায় মাইক্রোবায়োলজি এবং বায়োকেমিস্ট বিভাগের সমন্বয় করা যেত।
তবে বেশিরভাগ স্থানে সেটি হয়নি। ফলে একটানা কাজ করে ভাইরোলজিস্টরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আবার টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়ার ধীর গতির কারণে সামগ্রিক কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ল্যাবে বাইরে থেকে লোকবল নিয়ে কাজ করানো হলেও তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা বা সুযোগসুবিধা নেই। ফলে তারাও কাজ করতে চাইছে না।
এদিকে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহে জটিলতা দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েও নমুনা দিতে পারছেন না। বাড়ি বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
ফলে বিপাকে পড়েছে করোনা আক্রান্তরা। অপরদিকে পিসিআর মেশিন ও পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাবে পরীক্ষার সংখ্যাও কম। দিন দিন সংগৃহীত নমুনার পরীক্ষা দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে ৫-৭ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষানিরীক্ষায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী দেশে এই মুহূর্তে অন্ততপক্ষে ১ লাখ ৫০ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা প্রয়োজন।
আছে মাত্র ৫১৮৪ জন। অবিলম্বে অন্ততপক্ষে ১৫ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। গত এক দশক ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা সংক্রান্ত সমন্বিত কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৪২টি টিসিআর (পলিমার চেইন রিএ্যাকশন) ল্যাবে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা চলছে।
এরমধ্যে ২১টি ঢাকায় এবং ২১টি ঢাকার বাইরে। এগুলো হল- আর্মড ফোর্সেস ইন্সটিটিউট অব প্যাথলজি ও সিএমএইচ, বিএসএমএমইউ, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন ও ঢাকা শিশু হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, আইসিডিডিআরবি, আইদেশী, এনপিএমএল- আইপিএইচ, আইইডিসিআর, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, মুগদা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল-ঢাকা, এভারকেয়ার হাসপাতাল ঢাকা, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড-ঢাকা, প্রাভা হেলথ বাংলাদেশ লিমিটেড, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বিআইটিআইডি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ-নোয়াখালী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ- জামালপুর, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ-বগুড়া, রংপুর মেডিকেল কলেজ, এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ-দিনাজপুর, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, শের-এ-বাংলা মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, গাজী কোভিড-১৯ পিসিআর ল্যাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মো. সেলিম মোল্লা এক বিবৃতিতে বলেন, সরকারি পর্যায়ে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের স্বল্পতায় করোনা নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষায় জটিলতা দেখা দিয়েছে।
এটা নিরসন এবং করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা সুনিশ্চিত করতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ দানে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়িত হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে