খবর৭১ঃ
করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বেই বেকার বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। শুধু এপ্রিল মাসে ২ কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে দেশটিতে। ১৯৩০ সালে বিশ্ব মহামন্দার পর এতটা খারাপ সময় পার করেনি দেশটি। সবমিলিয়ে দেশটিতে বেকার ভাতার আবেদন জানিয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখের বেশি মানুষ। অথচ মাত্র এক মাস আগেও দেশটির বেকারত্বের হার ছিল মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ; যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
একই অবস্থা ইউরোপের দেশগুলোতেও। কঠিন সময়ে মানুষের চাকরি ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩৩০ কোটি কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৮১ শতাংশই ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কারখানা পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ হিসেবে বিশ্বের পাঁচ জন কর্মজীবীর চার জনই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ইউরোপের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। লকডাউন ও মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব দেশে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। তবে বিভিন্ন দেশের সরকার চাকরিচ্যুতি ঠেকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
কোভিড-১৯-এর বিস্তার ঠেকাতে দেশে দেশে চলছে লকডাউন। অনেকেই লকডাউন শিথিল করেছে। কিন্তু পূর্ণমাত্রায় কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে মানুষকে ঘরে থাকতে বলায় থমকে গেছে যানবাহন ও কলকারখানার চাকা। স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতিও। এ অবস্থায় দেশে দেশে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন কোটি কোটি মানুষ।
ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, বিশ্বের বড়ো প্রায় সব অর্থনীতির এবারে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হবে। চীন ও ভারত বৃহত্ জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি না হলেও অর্থনীতির গতি রেকর্ড কমে যাবে। অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ বলেছেন, ২০২৩ সালের আগে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গতি আসবে না। এরইমধ্যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের সবাই কাজের সুযোগও পাবেন না। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় থাকলেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর বেকাররা দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে। এসব বলা হলেও বাস্তবে করোনা ভাইরাস অর্থনীতিতে কতটা ক্ষতি করতে পারে সেটি অননুমেয়। কারণ ইতিমধ্যে বিশ্বের বড়ো অর্থনীতির দেশগুলো অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু মন্দার কবল থেকে পরিত্রাণ মিলছে না তাদেরও।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশেও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আরো বেড়ে গেল। করোনা পরিস্থিতি এখন দেশের সব খাতেই প্রভাব ফেলছে। তবে অনানুষ্ঠানিক খাতে এর প্রভাব বেশি, এরই মধ্যে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। করোনার বিস্তার ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন পরিবহনশ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুর, হোটেল-রেস্তোরাঁকর্মী, ছোটো দোকানদার। আর নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অনেকেই রয়েছেন চাকরি হারানোর শঙ্কায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে, দেশের ৫ কোটি ১৭ লাখ শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছে। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ ভাগ। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হওয়ায় এই বিপুল পরিমাণ মানুষ রয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। লকডাউনের ফলে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজ না করলে কোনো উপার্জন থাকে না বলে জীবনযাত্রার মানও তাদের উন্নত নয়। বিবিএসের হিসেবে ২০১৯ সাল শেষে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম এক গবেষণায় বলেছে, যদি পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকে সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আয় ২৫ ভাগ কমে গেলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখা আরো ২০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো দুর্যোগ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপরই সবার আগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। করোনা ভাইরাসের অভিঘাতও এই শ্রেণির শ্রমিকদের ওপরই প্রথমে পড়েছে। অথচ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের রয়েছে বড়ো ভূমিকা। আর দুর্যোগ কেটে গেলেও যে কাজে ফিরবেন, সে নিশ্চয়তা নেই তাদের। এজন্য কাজ হারানো এই মানুষগুলো রয়েছেন বেশি ঝুঁকিতে।