খবর৭১ঃ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নববর্ষকে আবাহন করে বলেছিলেন ‘জাগো ফুলে ফলে নব তৃণদলে/তাপস, লোচন মেলো হে। /জাগো মানবের আশায় ভাষায়, /নাচের চরণ ফেলো হে। /জাগো ধনে ধানে, জাগো গানে গানে,/জাগো সংগ্রামে, জাগো সন্ধানে, /আশ্বাসহারা উদাস পরানে /জাগাও উদার নৃত্য।’ রবিঠাকুরের পঙ্ক্তির ভাষার মতো বাংলার মানুষ জাগবে, এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করবে।
আজ যে পহেলা বৈশাখ। বাঙালির জীবনে আজ নতুন বছরের প্রথম দিন, নতুন বারতা। আজকের সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূচনা হল বাংলা ১৪২৭ সালের। তবে আজকের এই বৈশাখ বাঙালির জীবনের যেকোনো বৈশাখের চেয়ে আলাদা। করোনা মহামারীর কারণে বৈশ্বিক এই দুর্যোগের সময় আমাদের জীবন অবরুদ্ধ। ঘরে বসেই দেশের মানুষ মোকাবেলা করছে এই মহামারীর। আজ পহেলা বৈশাখের বাংলা ঢোলের বাজনা বাজবে বাঙালির মনে মনে। প্রাণে প্রাণ মিলবে রাস্তা বা খোলা ময়দানে নয়, যার যার বাসায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ম্যাসেঞ্জারে। আজ পহেলা বৈশাখের উৎসব হবে বাংলার ঘরে ঘরে, নিজের মতো করে।
১৪২৬-এর আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার হিসাব চুকিয়ে শুরু হবে নতুন এক পথচলা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সার্বজনীন উৎসবে ঘরে ঘরে মেতে ওঠা বাঙালি গাইবে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। বাংলার গ্রাম, শহর, বন্দর, সব জায়গায় আজ দোলা দেবে পহেলা বৈশাখ তবে সেটা একটু অন্যভাবে। পান্তা-ইলিশ খাওয়া, মুড়ি-মুড়কি, মন্ডা-মিঠাই সবই হবে, তবে তা যার যার ঘরে।
পহেলা বৈশাখ তথা ডিজিটালি বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে ডাকে সাড়া দিয়ে সীমিত আকারে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। ‘উৎসব নয়, সময় এখন দুর্যোগ প্রতিরোধের’- এ প্রতিপাদ্যে সীমিত আকারে বর্ষবরণের আয়োজন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে দুই দিন আগে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতি দেয়া হয়। এতে জানানো হয়, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নবসজ্জার অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে আজ পহেলা বৈশাখ ভোর ৭টা থেকে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছ থেকে সকল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এ অনুষ্ঠানের ফ্রেশ ফিড পাবে।
এই অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে সাম্প্রতিক নানা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের নির্বাচিত গান এবং বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপটে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুনের সমাপনী কথন দিয়ে, যা বিটিভি ছাড়াও ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলেও সম্প্রচারিত হবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আরেকটি ধারণকৃত অনুষ্ঠান বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার করা হবে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারণকৃত একটি বক্তব্য ছাড়াও বৈশাখের গান, নৃত্য, আবৃত্তি আয়োজন থাকবে। ফেসবুকে ডিজিটালি বর্ষবরণের আয়োজন করেছে উদীচী। অন্যদিকে জনসমাগম না করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’ প্রতিপাদ্য করে এবারে বর্ষবরণের আয়োজন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবারের পহেলা বৈশাখের রংটাই পাল্টে দিয়েছে। ভাইরাসটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণরূপে ব্যাহত করেছে। জনসমাগম এড়িয়ে চলাই এই ভাইরাস প্রতিরোধের সর্বোত্তম পন্থা। তাই সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এ ছুটি বলবৎ থাকবে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত। ছুটি বলা হলেও কার্যত লকডাউন অবস্থার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে দেশ। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এমনিতেও অনেক জেলা, শহর, এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। সীমিত করা হয়েছে মানুষের চলাচল। একেবারেই প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঘরের বাইরে যেতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। সে কারণে অন্যান্য সময় পহেলা বৈশাখের আগে যে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে তা এবার অনুপস্থিত। দোকানপাট বন্ধ বলে পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্য হালখাতার আয়োজন নেই, নেই বৈশাখী কেনাকাটা। নেই পান্তা-ইলিশ আয়োজনের তোড়জোড়।
এই মহাদুর্যোগের মধ্যেই বৈশাখ আসায় সরকারি আদেশেই এদিন খোলামাঠে সকল আয়োজন বন্ধ। পহেলা বৈশাখের অন্যতম আয়োজন রমনা বটমূলে প্রভাতী আয়োজন, মঙ্গল শোভাযাত্রা, শিশু পার্কের সামনে ঋষিজের অনুষ্ঠানসহ সব বন্ধ করা হয়েছে। বাঙালি আজ ঘরে বসেই তার সাধ্যমতো খাবার আয়োজন করবে। পড়বে নতুন পোশাক। মোবাইল মেসেজ বা অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় করে নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নেবে। ঘরে বসে থাকলেও তাদের মনে সত্যি সত্যি খেলে যাবে বৈশাখের রং।
আজকের অন্যরকম পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশবাসীকে নতুন বাংলা বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানরা। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের। আরও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলগুলো এ উপলক্ষে প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে ক্রোড়পত্র ও বিশেষ নিবন্ধ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।