করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি: পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৫ পদক্ষেপ জরুরি

0
491
যা করবেন করোনা সন্দেহ হলে

খবর৭১ঃ

করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। ইতোমধ্যে বৈদেশিক ও স্বাস্থ্য খাত, সরকারি অর্থায়ন ও মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি হয়েছে একরকম বিশৃঙ্খলা।

বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঁচটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

এগুলো হচ্ছে- উন্নয়ন ব্যয় কমানো, নজরদারি বাড়িয়ে রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ করা, স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ জোর দেয়া, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানো এবং ব্যবসায়ীদের জন্য স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা। করোনায় সৃষ্ট সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে কী করণীয়- এমন প্রশ্নের জবাবে যুগান্তরের কাছে এসব পরামর্শ দেন তারা।

পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রাথমিকভাবে ৬৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক চার সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং ইসলামিক ডেভেলেপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)।

এসব সহায়তার উল্লেখযোগ্য অংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বিনা সুদে দেয়া হবে। এসব সংস্থার কাছে তহবিলের জন্য এখনই বাংলাদেশের আবেদন করা উচিত বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, করোনার কারণে সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।

এক্ষেত্রে সরকারকে স্বীকার করতে হবে, অর্থনীতিতে কিছুটা মন্দা আসছে। তাই পরিস্থিতি মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য আনা জরুরি। বিশেষ করে সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দ কমিয়ে আনতে হবে। কারণ সরকারের অযথা কিছু ব্যয় রয়েছে। এগুলো কমানো দরকার। সবার আগে জোর দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতে। এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ওই পদক্ষেপের আওতা আরও বাড়াতে হবে। এ ছাড়াও ব্যয়ের গুণগতমান কঠোর নজরদারি করা জরুরি। বিশেষ করে যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়াতে হবে। অন্যদিকে আয়ের ক্ষেত্রে কর ফাঁকি রোধে নিতে হবে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ।

মির্জ্জা আজিজ বলেন, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ব্যবসা-বাণিজ্য। করোনার কারণে এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যবসায়ীদের ঋণের সুদের হার কমানো জরুরি। সারা বিশ্বই এ সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে সুদের হার কমানোর সুযোগ খুব বেশি নেই। এরপর যতটুকু সম্ভব ঋণের সুদ কমিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোয় স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেই অর্থ স্বল্পসুদে ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে পারে।

এদিকে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সেখানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের ৫ খাতে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এর মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক খাত, সরবরাহ ব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কাণ্ডে বিশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য খাত, সরকারি অর্থায়ন এবং মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থা। আমদানি, রফতানি, রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রভাব এবং পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে মন্দার কবলে পড়বে অর্থনীতি। এতে মানুষের আয় কমবে।

এমনকি বেকার হবে অনেকেই। সামগ্রিকভাবে রাজস্ব আদায়ে চলমান নেতিবাচক অবস্থাকে আরও প্রভাবিত করবে। এতে বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

জানতে চাইলে সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে আমরা আপৎকালীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

এটি কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, এজন্য সবার আগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে স্বাস্থ্য খাত। এর আগে স্বাস্থ্য খাতে কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে এর মূল্য দিতে হচ্ছে।

এ কারণে এখন অন্য খাত থেকে অর্থ এনেও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিম্ন আয়ের মানুষের খাবার নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করা উচিত।

এসব কাজ করার ক্ষেত্রে অর্থের সমস্যা হলে উন্নয়ন ব্যয় কমানো যেতে পারে। তার মতে, বেশকিছু প্রকল্প আছে, যার ব্যয় এখন না করলেও চলে, এগুলোর ব্যয় বন্ধ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, এরপর মধ্যমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

এর মধ্যে রয়েছে রফতানি প্রণোদনা দেয়া, ব্যবসায়ীদের ঋণের সুদের হার কমানো এবং আগামী বাজেটে বিভিন্ন খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে স্বাস্থ্য খাতের সহায়তার জন্য বাংলাদেশের আবেদন করা উচিত।

সিপিডির ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠানটির কাছে ১০ কোটি ডলার সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।

এছাড়া ৫০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এর মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে বিনা সুদে ১০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে। সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘোষণা দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

এ ছাড়াও ৭৩ কোটি ডলারের বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)। এই অর্থ সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যে দেয়া হবে।

সিপিডি বলছে, করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে সুনির্দিষ্ট ওষুধের উৎপাদন, সরবরাহ এবং বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো এবং ডাক্তারদের মেডিকেল সরঞ্জামাদি সরবরাহের ব্যাপারেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে নতুন ফাইন্যান্সিয়াল চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্য চাহিদার কারণে কৃষি খাতের ওপর চাপ আসবে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তাদের নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে পণ্যের সরবরাহ, উৎপাদন, আমদানি, মজুদ এবং রফতানির বিষয়ে কঠোর নজরদারি জরুরি।

পরবর্তী ৩ থেকে ৪ মাস বেসরকারি খাতকে আমদানি বাড়াতে উৎসাহিত করা উচিত। যেসব পণ্য এ মুহূর্তে খুব জরুরি, সেগুলো আমদানি করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে- খাদ্য, বিভিন্ন কাঁচামাল এবং প্রাথমিক যন্ত্রাংশ।

এক্ষেত্রে বেশকিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যেমন- জরুরি খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য পণ্য। সাময়িক সময়ের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।

এ ছাড়াও দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর খাবার নিশ্চিত করতে সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে খোলাবাজারে কম দামে পণ্য বিক্রি (ওএমএস) বাড়াতে হবে।

পাশাপাশি রফতানি খাতকে বিশেষ সহায়তা দিতে হবে। বিশেষ করে এলসি (ঋণপত্র) নিষ্পত্তি, সুদের হার কমানো এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here