খবর৭১ঃ
ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে ঢাকাসহ সমগ্র দেশবাসীকে গতবারের চেয়ে বেশি খেসরাত দেয়া লাগতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, গত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলাকালীন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়েছিল। এরপর দুই সিটির মশক নিয়ন্ত্রণে যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সেগুলো ছিল কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটির তেমন কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। কেননা এডিস মশা ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ভিন্ন ধরনের।
আগামী দুই মাসের মধ্যে দুই সিটি কর্পোরেশন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে টেকসই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। নইলে এবার গত বছরের চেয়ে চরম মূল্য দিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু ঢাকার দুই সিটির সে ধরনের তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে।
গত বছর মশার উপদ্রব কমার পর এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এখনও কিছুটা সময় আছে। ঢাকার দুই সিটি চাইলে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাম্প্রতিক এক জরিপেও উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১২ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১০ শতাংশ এলাকায় এডিস লার্ভার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতির চিত্রও উঠে এসেছে।
এতে দেখা যায়, দক্ষিণ সিটির ৫নং ওয়ার্ডের মুগদা, ৬নং ওয়ার্র্ডের মায়াকানন, ১১নং ওয়ার্ডের শাহজাহানপুর ও ১৭নং ওয়ার্ডের কলাবাগান এলাকা এবং উত্তর সিটির ১নং ওয়ার্ডের উত্তরা ৪নং সেক্টর, ১৬নং ওয়ার্ডের কাফরুল, ২৮নং ওয়ার্ডের পশ্চিম আগারগাঁও ও ৩১নং ওয়ার্ডের নূরজাহান রোড এলাকায় এডিসের লার্ভার ঘনত্ব সূচক ইনডেক্স ২০ পয়েন্টের বেশি মিলেছে।
দক্ষিণের ৩৭নং ওয়ার্ডের বাংলাবাজার এলাকায় ঘনত্ব সূচক ইনডেক্স ৭০ এবং ৪২নং ওয়ার্ডের লক্ষ্মীবাজার এলাকার ইনডেক্স ৫০ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে উত্তরের ১২নং ওয়ার্ডের তোলারবাগ এলাকায় এই সূচক ৩০ পয়েন্ট।
মশার লার্ভার উপস্থিতির হিসাব করা হয় এই ইনডেক্সের মাধ্যমে। প্রতি একশ’ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০ বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বলা হয় বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, মূল রাজধানীর ১৩৪ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার জলাশয় রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এসব জলাশয়ের মালিক।
সিটি কর্পোরেশনসহ সব সংস্থার নিজ নিজ জলাশয় পরিষ্কার করার দায়িত্ব থাকলেও কোনো সংস্থা তা করে না। এবার এসব জলাশয় পরিষ্কারে দুই সিটি কর্পোরেশনের স্বল্পপরিসরে তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। একইচিত্র অন্তত ৩০০ কিলোমিটার কার্পেটিং ড্রেনের ক্ষেত্রেও।
এসব কার্পেটিং ড্রেনে মশক নিয়ন্ত্রণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রমও পরিচালনা করতে পারছে না দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। পর্যায়ক্রমে কার্পেটিং ড্রেনগুলো উন্মুক্ত করার বিষয়ে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে তেমন কোনো উদ্যোগও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে ডিএনসিসির মশক নিধন খাতে বরাদ্দ ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। লোকবল রয়েছে ২৭০ জন। নতুন করে ৫৪টি ওয়ার্ডে ১০ জন করে জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
নতুন আধুনিক মানের ২৩৮টি ফগার মেশিন, ২০টি মিক্সড ব্লোয়ারসহ বেশকিছু সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়েছে। এছাড়া একজন কীটতত্ত্ববিদকে প্রধান করে ১০ জন শিক্ষানবিস কীটতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিমের মাধ্যমে ডিএনসিসি নিজ এলাকায় জরিপ পরিচালনা করেছে।
সেখান থেকে তারা জানতে পেরেছেন, ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের ৫৪০টি স্থানে ৬২০টি কিউলেক্স মশা প্রজননের হটস্পট রয়েছে। সেসব হটস্পটসহ ডিএনসিসি এলাকার সার্বিক পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে বিশেষ জোরদার করেছে।
অন্যদিকে ডিএসসিসি সূত্র জানায়, মশক নিয়ন্ত্রণে ৪০০ জন জনবল রয়েছে। নতুন করে ৭৫টি ওয়ার্ডে ১০ জন করে নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। এছাড়া নতুন করে ২৫০টি ফগার মেশিন ক্রয় করেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ডিএসসিসির মশক নিধন খাতে বরাদ্দ ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হলেও মশক নিয়ন্ত্রণে এই দুই সংস্থার তেমন কোনো সাফল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তারপরও মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতা ফুটেছে ডিএসসিসির।
এদিকে গত বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করলে ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সিঙ্গাপুর সফর করে। তারা মশার বন্ধ্যত্বকরণের জন্য বিশেষ প্রযুক্তি আমদানির উদ্যোগ নেয়া হলেও তা এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।
ডিএনসিসির তৎকালীন মেয়র আতিকুল ইসলামও কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন। পাশাপাশি কলকাতার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যিনি কাজ করেছেন, সেই বিশেষজ্ঞ অনিক ঘোষের সঙ্গেও কথা বলেন। দুই সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে কলকাতার একটি বিশেষজ্ঞ দলকেও ঢাকায় আনা হয়।
কিন্তু এরপর আর কোনো কার্যক্রম নেই। এমনকি সচেতনতামূলক যেসব কার্যক্রম চলার কথা, সেগুলোও দেখা যাচ্ছে না। নালা, পুকুর, ডোবা, জলাশয় পরিষ্কার কার্যক্রমও চোখে পড়ছে না। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমেও খালগুলোতে পানিপ্রবাহ প্রায় না থাকায় বদ্ধ জলাশয়গুলো মশার উৎকৃষ্ট প্রজননস্থলে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোমিনুর রহমান মামুন যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গুর উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে আমরা নিরলসভাবে কাজ করছি।
জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মশার লার্ভা নিধনসহ নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এ কাজ শুধু সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। এজন্য নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে।
অন্যদিকে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শরীফ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ব্যাপারে সতর্কতা জারি করার পর এলাকাভিত্তিক মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।
এসব কাজে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে এবং ওয়ার্ডভিত্তিক ১০ জন করে মশক নিধন কর্মী নিয়োগের কাজ চলছে। শিগগিরই এসব কর্মী নিয়োগ করা হবে।