খবর৭১ঃ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯) বড়ো আঘাত হানছে অর্থনীতিতে। বিশ্লেষকরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ২০০৮ সালে শুরু হওয়া বিশ্বমন্দাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এর প্রভাব। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারে দর পড়ে গেছে ব্যাপকহারে। গেল সপ্তাহজুড়েই খারাপ সময় পার করেছে বিশ্বের বড়ো বড়ো শেয়ারবাজার। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত সপ্তাহে ৫ ট্রিলিয়ন (৫ লাখ কোটি) ডলার হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। মন্দার পর এমন পতন আর দেখা যায়নি। কমছে জ্বালানি তেলের দামও। করোনা ভাইরাসের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে আশা করা হলেও ঘটছে উলটোটা। করোনা ছড়িয়েছে ৫৩টি দেশে। বিশ্বব্যাপী মহামারি রূপ নেওয়ার আতঙ্ক শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে।
উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশেও। চীন থেকে পণ্য আনা ব্যাহত হওয়ায় ইতিমধ্যে প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টসের এক্সেসরিজের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানিয়েছে এ খাতের শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী বড়ো বড়ো ব্র্যান্ডের খুচরা দোকান বন্ধ হওয়ার খবরও জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি ড. রুবানা হক। গতকাল ইত্তেফাককে তিনি বলেন, এ কারণে ব্র্যান্ডগুলোর মুনাফা কমে গেছে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে কাঁচামাল ও এক্সেসরিজের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় কারখানাগুলোর মজুত ফুরিয়ে আসছে। এর ফলে উত্পাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিমানে পণ্য পাঠানো, বায়ারকে ডিসকাউন্ট দেওয়া কিংবা অর্ডার বাতিল হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা এ খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য বড়ো ক্ষতির কারণ হবে। অন্যদিকে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে চামড়াজাত পণ্য ও কাঁকড়া রপ্তানিকারকরা বড়ো অঙ্কের ক্ষতির শিকার হতে যাচ্ছেন।
দেশের অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর্যায়ে চলে গেছে। এতে বড়ো ধরনের বিশ্বমন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে এ ভাইরাস কতটা বিস্তৃত হয় এবং কত দিন স্থায়ী থাকে—তার ওপর নির্ভর করবে ক্ষতির অবস্থা। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে টান পড়তে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকেই যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিও খারাপের দিকে ছিল। এটি আরো খারাপ হবে। কেননা রাজস্ব আয়ও কমবে। এটি কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
বিশ্ব শেয়ারবাজারে ধস
সবমিলিয়ে করোনার প্রভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এক টালমাটাল অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। গতকাল শুক্রবার দিনের শুরুতেই ইউরোপের শেয়ারবাজারে বড়ো দরপতন লক্ষ্য করা গেছে। লন্ডন শেয়ারবাজারে প্রধান সূচক ১০০ পয়েন্টের বেশি কমেছে। ফলে ৩ শতাংশ পড়েছে শেয়ার দর। সবচেয়ে বড়ো পতন হয়েছে মার্কিন শেয়ারবাজারে। একদিনের ব্যবধানে বৃহস্পতিবার মার্কিন ডো জোনস সূচক রেকর্ড ১ হাজার ১৯০ পয়েন্ট কমেছে। ফলে ১০ শতাংশ দর হারিয়েছেন মার্কিন শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। পতন লক্ষ্য করা গেছে এশিয়ার শেয়ারবাজারেও। এশিয়ার বড়ো শেয়ারবাজার জাপানের নিক্কি সূচক পড়েছে ২২৫ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। শুধু শুক্রবার চীনের সাংহাই কম্পোজিট সূচক পড়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। মার্কিন সরকারি বন্ডকে সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ মনে করা হলেও এর বিক্রি রেকর্ড নিচে নেমে গেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও নেমে গেছে। গতকাল প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দর ৩ শতাংশ কমে ৫০ দশমিক ৩১ ডলারে বিক্রি হয়েছে। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, বড়ো বড়ো ক্রীড়া ইভেন্ট এবং ব্যাবসায়িক সম্মেলন স্থগিত করা হচ্ছে।
মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগকারী ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস সতর্ক করে বলেছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমানো না গেলে এ বছর মার্কিন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের মুখ দেখবে না। অ্যাপল ও মাইক্রোসফটের মতো বৃহত্ প্রতিষ্ঠানও ইতোমধ্যে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন করোনা ভাইরাস দীর্ঘায়িত ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে বড়ো বিশ্বমন্দার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। গতকাল ইত্তেফাককে তিনি বলেন, এই ভাইরাস এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এলে বিশ্বব্যাপী আর্থিক ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু তা কমছে না, বরং প্রতিদিনই এর রূপ বদলাচ্ছে। নতুন নতুন দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। এটি আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে বৈশ্বিক সরবরাহ চেন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। ফলে সরবরাহ ও চাহিদা উভয়ই কমতে পারে। ফলে তা বিশ্বমন্দা ডেকে আনতে পারে। তবে এর ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করবে, মন্দা কত গভীর হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দা শুরুর কারণ ছিল বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মনীতির দুর্বলতা থাকায় আর্থিক সমস্যা থেকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন, ভাইরাস সমস্যা। ১৯১৮ সালের পর এবারের করোনা ভাইরাসের প্রভাব অন্যতম বড়ো আঘাত।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
দেশে উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছে। এককভাবে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৭৯ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। এর মধ্যে বাংলাদেশ ১ হাজার ৩৮৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে ৮৩ কোটি ডলারের পণ্য। করোনা ভাইরাস ইস্যুতে শুরুতে উদ্যোক্তারা কিছুটা নরম সুরে কথা বললেও দিন দিনই এর বিস্তার বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে। চীন থেকে পণ্য আসা ব্যাহত হওয়ায় ইতিমধ্যে ক্ষতির মুখে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। ২৭টি বাণিজ্য সংগঠন ও চেম্বার তাদের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের কাছে। তাদের বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে চীনের বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলরও এফবিসিসিআইর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। বিশেষত দেশটির পরিবহন, কার্গো শিপমেন্ট কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কথা জানিয়েছে। এতে বলা হয়, এর ফলে উভয় দেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বড়ো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাংলাদেশে চীন থেকে বছরে গার্মেন্টস পণ্যের কাঁচামালই আমদানি হয় ৫০২ কোটি ডলারের। অন্যদিকে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসের এক্সেসরিজের ৪০ শতাংশ আসে দেশটি থেকে। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক জানিয়েছেন, বেশকিছু এক্সেসরিজের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই পরিস্থিতি উদ্যোক্তাদের রীতিমতো মেরে ফেলছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে চীনের সরবরাহ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না হলে আমরা প্রায় তিন মাসের ক্ষতির মুখে পড়ব।
বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড়ো বাজার এখন চীন। এ খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশই যায় চীনের বাজারে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে দেশটিতে রপ্তানি বলতে গেলে বন্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশ ফিনিশ্ড লেদার, লেদারগুড্স অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) তথ্য অনুযায়ী, আগে চীনে রপ্তানির ক্ষেত্রে সংগঠনটি থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি সনদ (রপ্তানির অনুমোদন) প্রদান করা হতো। এটি এখন প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। অর্থাত্ আপাতত ক্রয়াদেশ তলানিকে। এ পরিস্থিতিতে সংকটের মধ্যে থাকা এ খাত ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএফএলএলএফইএর সাবেক সভাপতি টিপু সুলতান। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, অনেকেই পণ্য তৈরি করে রাখলেও তা পাঠাতে পারছেন না।