খবর৭১ঃ পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এক সময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে। পদ্মার তীর থেকে দেখা যাচ্ছে পিলারের দীর্ঘ সারি। তার উপর একে একে বসানো হচ্ছে ইস্পাতের কাঠামো (স্প্যান)। শুক্রবার বসানো হল ২৫তম স্প্যান। সবমিলিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার দৃশ্যমান।
বাকি পিলারের উপর বসবে আর ১৬টি স্প্যান। এ কাজ শেষ হবে জুলাইয়ে। এরপর থেকেই শুরু হবে সেতু ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষা। সবকিছু ঠিক থাকলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ২০২১ সালের জুনে উদ্বোধন হচ্ছে স্বপ্নের সৌধ। উদ্বোধনের পর থেকেই শুরু হবে স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। সময়কে উপেক্ষা করে সেতু দিয়ে ছুটবে বাস, ট্রাক, ট্রেন সব।
সেতুটি চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ। নতুন করে গড়ে উঠবে ভারি শিল্প কারখানা। আর এরই অপেক্ষায় যেন বাংলাদেশ।
পদ্মা সেতু শুধু রড, সিমেন্ট ও পাথরের সেতু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৬ কোটি মানুষের আবেগ। চ্যালেঞ্জকে জয় করার অদম্য স্পৃহা এবং আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আর্ন্তজাতিক আরও তিনটি সংস্থা- এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
এতে পদ্মার আকাশে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। যা ওই বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০ শতাংশ। ফলে নাগালের বাইরে চলে যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন। পরের ইতিহাস সবার জানা। সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
এতেই কেটে যায় কালো মেঘ, দিগন্ত আলোকিত করে হেসে উঠে সূর্য। সেতু নির্মাণের কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে শুরু হয় স্বপ্নের বীজ বোনা। আর সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে ধরা দিচ্ছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সেতু বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে সরাসরি এর সুফল আসবে। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে অর্থনীতিতে সরাসরি তিন ধরনের সুবিধা রয়েছে।
প্রথমত, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে। বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে। তৃতীয়ত, এ সেতুর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে। বিশেষ করে ভারতের বাণিজ্য বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে।
প্রকল্পের ৪১টি স্প্যানের মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত ২৫টি বসানো শেষ হয়েছে। এতে প্রায় চার কিমি. সেতু দৃশ্যমান হয়। এপ্রিলের মধ্যে সেতুর ৪২টি পিলারের মধ্যে বাকি চারটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এর তিন মাসের মধ্যেই শেষ হবে অবশিষ্ট স্প্যান বসানোর কাজও। ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূল সেতু নির্মাণে অগ্রগতি হয়েছে ৮৬ শতাংশ।
সার্বিকভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৭ ভাগ। এর মধ্যে নদীশাসন কাজ ৬৮ ভাগ, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া ১০০ ভাগ এবং ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ উন্নয়ন কাজ ৮০ ভাগ। এ সেতু নির্মাণ অগ্রগতির সঙ্গে ভাগ্য ফিরছে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের জমির দামের বাইরে অতিরিক্ত ৬৬৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে। প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৭৯৩টি। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ, শিক্ষার জন্য স্কুল নির্মাণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এটি আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এ সেতুর মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাবে। ইতিমধ্যে এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠছে। সেগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। সবমিলিয়ে এটি বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য খুলে যাচ্ছে। সেতুকে ঘিরেই মানুষের জীবনযাত্রার মানও বদলাচ্ছে। এখানে বিশ্বমানের অলিম্পিক ভিলেজ, বেনারসি তাঁতপল্লী, রাজউকের উদ্যোগে আইকন টাওয়ার, দেশের মধ্যে একমাত্র ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমিসহ বড় বড় প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে।
পদ্মা সেতুতে জমি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাসিন্দা নুর ইসলাম মাদবর। সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, পৈতৃক ভিটা, কৃষি জমিসহ অনেক জমিজমা হারিয়েছি। তবে আবাসন প্রকল্পে প্লট পেয়েছি। কিন্তু পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞে আমার পরিবার খুশি। আমরা মনে করছি, এ সেতুর মধ্যমে সারা দেশের যে উপকার হবে তাতেও ভাগীদার হতে পারলাম।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে অগ্রগতি : জানা গেছে, সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে পদ্মা সেতু। জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। আর্থিক অগ্রগতির হার ৭১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
আর বাস্তবিক অগ্রগতি আরও বেশি ৭৭ শতাংশ। প্রকল্পের মূল অঙ্গভিত্তিক হিসাবে মূল সেতু নির্মাণে বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৮৬ ভাগ। জুনের মধ্যে সেতুর বাকি কাজ নির্মাণের সময় ধরা রয়েছে। তবে চীনে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দীর্ঘস্থায়ী হলে এর প্রভাব পদ্মা সেতুতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
মূল সেতুর চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে নদীশাসন কাজ। ৩০ জুনের মধ্যে এ কাজ শেষ করার সময় নির্ধারিত থাকলেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নদীশাসন কাজের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৬৮ ভাগ। আর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি প্রায় ৮০ শতাংশ। নদীশাসনের কাজ করছে সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন। আর সেতুর সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়াগুলো নির্মাণ অনেক আগেই শেষ হয়েছে।
জানা গেছে, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে বসবে ৪১টি স্প্যান ও ৪২টি পিলার। শুক্রবার ২৫তম স্প্যান বসেছে। মাওয়ায় এ পর্যন্ত ৩৭টি স্প্যান এসে পৌঁছেছে। দুটি স্প্যান পথে ও দুটি তৈরির কাজ চলছে। সব মার্চের মধ্যে আসা এবং জুলাইয়ের মধ্যে স্থাপনের কথা রয়েছে। আর ৪২টি পিলারের মধ্যে ৩৮টির কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। বাকি ৪টির কাজ এপ্রিলে শেষ হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার পদ্মা নদীর শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী রুটে ২ হাজার ৮৬০টি গাড়ি ফেরিতে পার হয়েছে। একইদিন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় পার হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭টি গাড়ি।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, চালু হওয়ার পর পদ্মা সেতুতে দৈনিক অন্তত ৬ থেকে ৭ হাজার গাড়ি পারাপার হবে। কারণ, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ায় ফেরি ঘাটের বিড়ম্বনা এড়াতে সিংহভাগ গাড়ির গন্তব্য হবে পদ্মা সেতু। এতে সময় ও শ্রম দুই বাঁচবে গাড়িগুলোর।
ভাগ্য ফিরছে ক্ষতিগ্রস্তদেরও : প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও শ্রীনগর, মাদারীপুরের শিবচর ও শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার ১৭ হাজার ৩২৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এসব এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫৪২ হেক্টর। এসব জমি অধিগ্রহণে ভূমি মালিকদের ২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া অতিরিক্ত সহায়তা হিসাবে দেয়া হয়েছে ৬৮৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এছাড়া ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ২ হাজার ৭৯৩টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আর হস্তান্তর করা হয়েছে ২ হাজার ৬০২টি প্লট। এছাড়া তাদের জন্য চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাজার, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ১ হাজার ৫৮৭ জনকে কম্পিউটার, গরু-ছাগল পালন ও হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আলাদা প্রকল্প : পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকার স্থাপনা তৈরির কারণে ১ হাজার ৩০০ একর এলাকায় জলজ ও জলাভূমিতে বাস করা প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে ৮ কোটি ৮৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
প্রকল্প এলাকায় প্রায় ১ লাখ ৫৮ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়া পদ্মা সেতু এলাকায় ৬ কোটি ২১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি জীববৈচিত্র্যের ইতিহাস সংরক্ষণে একটি জাদুঘর স্থাপনের কাজও চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও নেয়া হয়েছে