শেখ কাজিম উদ্দিন, বেনাপোল : সেদিন আদরের ছোট্র সোনামনি বাবা-মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো বাবা’গো! মা’গো! আমি স্কুল থেকে ঐতিহাসিক মুজিব নগর শিক্ষা সফরে যাবো। আমি স্কুলের বন্ধুদের সাথে, স্যারেদের সাথে পিকনিকে যাবো। বলোনা “মা”! বলোনা “বাবা”! আমাকে যেতে দিবাতো?
সেদিন কোমলমতি সন্তানের আবদার ফেলতে পারেননি বাবা-মা। নিজ হাতে সন্তানদের সাজিয়ে দিয়েছিলো আর আনন্দের হাসি হেসেছিলো হৃদয়ের টুকরার সাজুগুজু আর মুখ ভরা হাসি দেখে।
কে জানত, এই সাজুগুজু কাল হয়ে আসবে? কে জানত, এক অমানিশার অন্ধকার আমার কলিজার টুকরাকে কেড়ে নিবে? কে জানত, আমার নিজ হাতে সাজগোজ করে দেওয়া আদরের ছোট্র সোনামনি লাশ হয়ে ফিরবে?
২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী। সেদিন বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুরা মুজিবনগরে দিনভর হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ ফুর্তি করে ফেরার পথে শিক্ষা সফরের বাস চৌগাছার ঝাউডাঙ্গায় সড়ক দূর্ঘনার কবলে পড়ে। সেদিনের সেই ভয়াল ট্রাজেডিতে আহত হয়েছিলো ২৫ জনের মতো কিন্তু আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো সুরাইয়া ও তার বোন জেবা আক্তার, রুনা আক্তার মীম, শান্ত, সাব্বির হোসেন, আঁখি, ইকরামুল ও ইয়ানুর রহমানসহ ৯টি কচি প্রাণ।
কে দিবে সেই নিজ হাতে সাজুগুজু করে দেওয়া ৯টি সন্তানের বাবা-মায়ের সান্তনা? আজ সেই ১৫ ফেব্রুয়ারী। চৌগাছা সড়ক ট্রাজেডির ৬বছর পূর্তি হলো। কিন্তু আজো সেই ভয়াল ট্রাজিডির সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত সন্তানদের বাবা-মায়ের চোখের জল মোছেনি! যেদিকে তাকাই, সেদিকেই দেখি বাবা-মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ আর বাতাসে স্বজন হারা অশ্রুজল। এখানে বক্তব্য দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। ক্ষমা করো বাবা-মা! আমরা তোমাদের সন্তানদের ফেরত দিতে পারিনি, ভবিষ্যতেও পারব না! তবে, দু’হাত তুলো দো’য়া করতে পারবো, ভবিষ্যতের জন্য আরো সচেতন হতে পারব, যাতে আর কোন বাবা-মায়ের এমন সন্তান হারানো বেদনা সইতে না হয়।
শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারী-২০২০) বেলা ৯টার সময় বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত ৯ শিশু স্মরণে দোয়া, শোক র্যালী ও আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদাণকালে এভাবেই প্রলাপ আর হৃদয় ভাঙ্গা আর্তনাদের মধ্যে কথাগুলি বলেছিলেন যশোর-১(শার্শা) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শেখ আফিল উদ্দিন।
বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মোস্তাক হোসেন স্বপনের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত উক্ত শোক দিবসের অনুষ্ঠানে শেখ আফিল উদ্দিন এমপি আরো বলেন, এখন থেকে শিক্ষা সফরের পিকনিক হোক সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফেরা। তাতে শিক্ষকরাই নির্ধারণ করবেন কতো দুরত্বে পিকনিকে যাবেন। নইলে এমন মর্মান্তিক ঘটনার পূর্ণরাবৃত্তি ঘটলে তার জবাবদিহিতা উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্টানকেই দিতে হবে।
এসময় সাংসদ শেখ আফিল উদ্দিন ৯ শিশু স্মরণে এক বাবার করুণ বক্তব্যের সুত্র ধরে বলেন, আমি শার্শা উপজেলাকে মাদক, ইভটিজিং ও সন্ত্রাস মুক্ত উপজেলা হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করলাম। এসময় তিনি স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা শার্শা উপজেলাতে কোন ইভটিজিং দেখতে চায়না। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর শ্লীতাহানি ও অন্যায় নির্যাতন দেখতে চায়না। আমি মাদক মুক্ত উপজেলা চায়। যেখানে থাকবে না কোন সন্ত্রাস, লুটেরার দল। সেজন্য পুলিশ প্রশাসনের যেকোন কঠিন পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসনীয় হবে। এদের বিরুদ্ধে আপোষ বা তদবির নয়, আমার সহযোগিতা থাকবে শতভাগ।
এসময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শার্শা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব নুরুজ্জামান, উপজেলা শিক্ষা অফিসার শেখ আব্দুর রব, বেনাপোল পোর্ট থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মামুন খান, যশোর জেলা পরিষদের সদস্য অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল, বেনাপোল পৌর আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলহাজ্ব এনামুল হক মুকুল, সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব নাসির উদ্দিন, যুগ্ম সম্পাদক মহাতাব উদ্দিন, বেনাপোল ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব বজলুর রহমান, পুটখালী ইউপি চেয়ারম্যান হাদিউজ্জামান, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রহিম সরদার, সাধারণ সম্পাদক ইকবল হোসেন রাসেল, বেনাপোল পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ও পৌর কাউন্সিলর আহাদুজ্জামান বকুল, পৌর কাউন্সিলর কামরুন নাহার আন্না, সেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি জুলফিকার আলী মন্টু, সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন, ছাত্রলীগের সভাপতি আল মামুন জোয়াদ্দার, সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান, সাবেক সহ সভাপতি আল ইমরান, সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন রুবেলসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, এলাকার সূধীবৃন্দ ও ২৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ শিক্ষার্থীরা।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বেনাপোল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক মুজিব নগর পিকনিকে যায়। সেখান থেকে ফেরার পথে চৌগাছার ঝাউদিয়া নামক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনা স্থলে নিহত হয় বেনাপোল পৌরসভার ছোট আঁচড়া গ্রামের সৈয়দ আলীর দুই মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সুরাইয়া (১০) ও তার বোন জেবা আক্তার (৮), ছোট আঁচড়া গ্রামের ইউনুস আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী মিথিলা (১০), রফিকুল ইসলামের মেয়ে চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রী রুনা আক্তার মীম (৯), লোকমান হোসেনের ছেলে চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র শান্ত (৯), গাজিপুর গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে সাব্বির হোসেন(১০), নামাজ গ্রামের হাসান আলীর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আঁখি (১১)। আহতবস্থায় ১৩ দিনপর হাসপাতালে চিকিৎসাধীনবস্থায় মারা যায় ছোটআঁচড়া গ্রামের মনির হোসেনের ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ইকরামুল (১১), ৩২ দিন পর ঢাকার সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় একই গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ইয়ানুর রহমান(১১)।