খবর৭১ঃ
মেধাবী ছাত্রী শ্রাবণী। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার। প্রতিবেশীরা বললেন, এত ভালো রেজাল্ট করল, মেয়েটিকে আরো লেখাপড়া করালেও পারত। কিন্তু শ্রাবণীর বাবা-মায়ের ভাষ্য, মেয়ে দেখতে সুন্দর, তাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কে নিয়ে যাওয়া-আসা করবে। তার চলাচল নিরাপদ নয়, ফলে তাকে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছি।
নিরাপত্তার কারণে দেশের অনেক কিশোরী শিক্ষার্থীর জীবনে এমন ঘটনা ঘটছে। বাল্যবিবাহের সঙ্গে নিরাপত্তার অভাবসহ বেশকিছু বিষয় জড়িত। অথচ সমাজে নারীর চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্য বদলাতে পারলে, সব ধরনের সহিংসতা কমে আসবে বলে জানান বিজ্ঞজনেরা। সরকার মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু স্কুল-কলেজে যাওয়ার পথ নিরাপদ হয়নি। ফলে অভিভাবকেরা মেয়েদের লেখাপড়ার চাইতে বিয়ে দিয়েই নিশ্চিত হতে চান। এ প্রবণতা বাড়ছে।
চলমান এসএসসি পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করছেন, তাদের সঙ্গে পিইসি পরীক্ষা দেওয়া বহু মেয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ জন শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালে এই শিক্ষার্থীরা যখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল তখন সবমিলিয়ে ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ২৬৫ জন শিক্ষার্থী ছিল। এবছর এসএসসির সময় ১০ লাখ ৪৬ হাজার শিক্ষার্থী কোনো হদিস মেলেনি। তারা হয়তো ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এই ৫ বছরে ঝরে পড়েছে। এক্ষেত্রে বহু শিক্ষাবিদ বলেছেন, মূলত নিরাপত্তার অভাব ও পড়াশোনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক বাবা-মা তাদের মেয়ে সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। অনেক অভিভাবক পড়াশোনা ও শিক্ষা উপকরণের খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের সব স্তরে নারীর অবস্থান শক্তিশালী করা জরুরি। নারী-শিশুদের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজে নারীকে ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি ও সম্মান দিতে হবে। খাদ্য ও পুষ্টির অভাব নারী-শিশুর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। সেটাও তাদের প্রতি এক ধরনের নির্যাতন। রাষ্ট্রকে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সরকার শুধু নয়, এ কাজে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এভাবে ঝরে পড়া সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার উদ্বেগের কারণ। ঝরে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা নিরাপত্তার অভাব। আমরা প্রতিদিন দুটো বিষয় দেখি। একটি সড়ক দুর্ঘটনা অন্যটি নারী নির্যাতন। মিডিয়ার মাধ্যমে প্রত্যেক বাবা-মা এই ঝুঁকির কথা জানেন। এ কারণে বাবা মা তার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে ভয় পায়।
তারা বলেছেন, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা—এসডিজি অর্জন করতে হলে, ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে এসডিজির পঞ্চম লক্ষ্য, নারী ও কন্যাশিশুর সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন। আর ১৬তম লক্ষ্য শিশুদের ওপর অত্যাচার, শোষণ, পাচার এবং সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। তারা বলছেন, বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের নাম নারী ও শিশু নির্যাতন। নারী ও শিশু নির্যাতনের পরিধি অনেক বিস্তৃত। নির্যাতনের শিকার বেশি হয় ঘরে এবং চেনা গন্ডিতে। বিষয়টি বাংলাদেশের উন্নয়নকে ঝুঁকিতে ফেলছে। নারীর ওপর যৌন বা শারীরিক নির্যাতন, হয়রানি, হত্যা-অপহরণ, বাল্যবিবাহ—এ সবই নারী-শিশুর সুরক্ষা ও অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে এগুলোর প্রতিরোধ এবং প্রতিকার বড়ো চ্যালেঞ্জ।
ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গণপরিবহনে চলাচলকারী নারীদের ৯৪ শতাংশ কোনো না কোনো সময় মৌখিক, শারীরিক ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। যৌন হয়রানি বা নিরাপত্তাহীন যাতায়াত শিশু ও নারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা কাজে যাওয়া থামিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রায় প্রতিটি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রেই আপরাধ করেও অপরাধীরা নির্বিঘ্নে সমাজে চলাফেরা করে। ফলে ভিকটিমের পরিবার সঠিক ও সুষ্ঠু বিচার থেকে বঞ্চিত হয় এবং হত্যা, আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সুস্থ, গণতান্ত্রিক, মানবিক, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হবে না। নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সমাজের সকলকে দায়িত্বশীল হতে হবে। নারী সংহতির সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা চন্দ্র বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সমাজে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ধর্ষণের সংস্কৃতি জিইয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, পাহাড়ে-সমতলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কল-কারখানায় পথে ঘাটে পরিবহনে কোথাও নারীর নিরাপত্তা নেই। এই নিরাপত্তাহীনতা জনগণের মধ্যে এক ভয় ও দিশেহারা পরিস্থিতি তৈরি করেছে।