খবর৭১ঃ ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফরের প্রথম পর্যায়। এই সফর নিয়ে সফর চলাকালীন সময়ের চেয়ে সফরের আগেই বরং কথা হয়েছে অনেক বেশি। আগেও একাধিকবার এ সফরটি অনেক দূর এগিয়েও বাতিল হয়েছে। সফররত শ্রীলঙ্কা দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল সম্পর্ক ইত্যাদি নানা কারণেই বারবার উদ্যোগ নিয়েও এতদিন সফরটি আয়োজন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সত্যি বলতে কি এবারও যে সফরটি হবে এমনটি আমার ধারণায়ও ছিল না। আমি স্থির নিশ্চিত ছিলাম আগের বারকয়েকের মতো এবারও সফরটি ঠিক বাতিল হবে। এমনকি এ নিয়ে বাজি ধরতেও রাজি ছিলাম আমি। বিশেষ করে আগে টেস্ট ম্যাচ আয়োজনে পিসিবি গো ধরে বসায় আমার এমন ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল।
হঠাৎই কীভাবে যেন সবকিছু ভোজবাজির মতো পাল্টে গেল। আমাদের প্রধান ক্রিকেটকর্তার ঐকান্তিক আগ্রহে অবশেষে অসম্ভব সম্ভব হলো। শুধু টেস্টই না, সঙ্গে উপরি হিসেবে টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে সিরিজও খেলছে বাংলাদেশ এবারের সফরে। একেই বোধহয় বলে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। এই সফরের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান আবার ফিরে এলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য নজরকাড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে এখন তারা বাকি দলগুলোকে তাদের দেশে খেলানোয় আরও বেশি আস্থাশীল হবে, যেমন আস্থাশীল হবে আর অন্যরাও কেউ কেউ সম্ভবত আস্থা পাবে পাকিস্তানে যেয়ে খেলে আসতে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি এই সফরটিকে মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। বাংলাদেশকে দিয়ে পাকিস্তানের এতটুকুও ভালো হোক এটি আমার প্রত্যাশার একেবারেই বাইরের বিষয়। তবে আমি ক্রিকেট সংগঠক নই। নই এমনকি সে রকম কোনো ক্রিকেটবোদ্ধাও। কাজেই এসব নিয়ে কোনো কথাও আমি বলিনি, এখনও বলব না। সত্যি বলতে কি এই সিরিজের একটি বলও কিংবা একটি রানও আমি টিভি অন করে দেখিনি। বরং বলা ভালো দেখার আগ্রহই বোধ করিনি। আমি ধরেই নিয়েছি যারা ক্রিকেট বোঝেন-জানেন তারা জেনে-বুঝেই অমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা এ বিষয়ে আমার চেয়ে যে অনেক বেশি যোগ্য সে নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। কাজেই আমার ব্যক্তিগত আবেগের জায়গাটুকু থেকে আমি কখনই এই সিরিজ সম্বন্ধে কোনো কিছু লিখব কিংবা বলব না, এ বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল থাকার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু ওই যে ইদানীং কথায় কথায়, সুযোগ পেলেই, ফাঁক-ফোকরে ফেসবুকে ঢু মারার কী যে এক বদ-অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে! সুযোগ পেলেই ঢু মারি আর এই সফর নিয়ে একের পর এক পোস্ট চোখে পড়ে। আমি ফেসবুকের বন্ধুতালিকাটা বাছাইয়ের ব্যাপারে বেশ সচেতন। আমার বন্ধুতালিকায় মুক্তিযুদ্ধে অবিশ্বাসী, আর এমনকি কম বিশ্বাসীদের ঠাঁই আমি দিতে চাই না। তারপরও যে সে রকম কেউ কেউ আমার বন্ধুতালিকায় নেই অমনটি আমি হলফ করে বলতে পারব না সত্যি, কিন্তু চোখেপড়া মাত্র তেমন কাউকে আমার বন্ধুতালিকা থেকে হটিয়ে দিতে আমার সময় লাগে না একদমই।
তারপরও আমি ফেসবুকে খেলার মাঠের বাইরের খেলা নিয়ে আমার বন্ধুদের অনেক স্ট্যাটাস দেখতে বাধ্য হয়েছি। ফেসবুক সয়লাব হয়েছে পুলিশ আর কমান্ড বেষ্টিত বাংলাদেশ দলের অরিজিনাল আর ডামি বাসের ছবিতে। একটা টিভির রিপোর্টিংয়ে জানলাম রেঞ্জাররাও ছিল আমাদের দলের নিরাপত্তার দায়িত্বে। বাংলাদেশের পতাকার সামনে অস্ত্রহাতে পাকিস্তানি কমান্ডোদের পাহারা দেয়ার ছবিও ফেসবুকে ঘুরছে। এসব ছবি আমার ফেসবুক বন্ধুদের অনেকের কাছেই প্রিয় হয়েছে। একেকজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীনরাষ্ট্র বলেই নাকি আমাদের এত বড় অর্জন। পাকিরা আজ আমাদের ক্রিকেটার আর পতাকার পাহারায়।
আমার কাছে কিন্তু বিষয়গুলোকে একেবারেই অন্যরকম মনে হয়েছে। যতবার আমি পাকিস্তানি নিরাপত্তারক্ষীদের পরিবেষ্টিত অবস্থায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বাসগুলোকে দেখেছি, আমার কেন যেন বারবার একটা ছবির কথাই মনে পড়েছে। ছবিটি তোলা হয়েছিল সম্ভবত একাত্তরের ২৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন তেজগাঁও বিমানবন্দরে। ওই যে বিষন্ন বঙ্গবন্ধু বন্দী অবস্থায় বসে আছেন আশপাশে পাকিস্তানি সেন্ট্রি পরিবেষ্টিত অবস্থায়, পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রতীক্ষায়। বারবার মনে পড়ছিল আরেকটি ছবির কথাও। লম্বা কালো চুলে লজ্জা নিবারণের চেষ্টারত সেই নাম না জানা বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার ছবিটি। তার মতো লক্ষ বীরাঙ্গনার জন্য এ দেশটাকে একদিন খুব বেশি অনিরাপদ করেছিল এ রকমই কিছু পাকিস্তানি রেঞ্জার আর নিরাপত্তারক্ষী যার জন্য সামান্য দুঃখ প্রকাশের উদারতাটুকু দেখানোর সময় আজও ওদের হয়নি।
টি-টোয়েন্টি সিরিজে হেরেছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা সামান্যই। খেলায় আজ এ হারবে তো জিতবে কাল। কিন্তু ফেসবুকে প্রগতিশীলদের স্ট্যাটাসগুলো দেখে কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল, ‘হারেনি বাংলাদেশ, কিন্তু হেরে গেলেন আপনারা’!