বেমানান পোর্ট্রেট

0
561
‘করোনাকাল’ থেকে ‘বাসন্তীকাল’
ডাঃ মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল, চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

খবর৭১ঃ সকালের পত্রিকাটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই বুকটা জুড়িয়ে গেল। জাতীয় সংসদের একাধিক মাননীয় সাংসদ ১৫ আগস্টের নেপথ্যের নায়কদের শনাক্ত করে বিচারের প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করেছেন। আমাদের একটা অদ্ভুত সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কথায় কথায় আমরা রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করি। ব্যাপারটা এমন- যেন আমরা সবাই দুগ্ধস্নাত তুলসীপাতা আর যত গলদ শুধু রাজনীতিবিদদের মধ্যেই। আমি নিজেও মাঝে মধ্যেই এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাই। কাজেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করার সুযোগ আমার নেই। তবে পত্রিকায় এই খবরটা দেখার পর দেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত না হয়ে পারিনি।

বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি এ ধরনের দাবি তুলছে বহুদিন আগ থেকেই। সম্প্রীতি বাংলাদেশ আর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একাধিক সভা-সেমিনারে আমি বিষয়টি আলোচিত হতে দেখেছি। দাবি তুলেছেন রাজনীতিবিদরাও। কিন্তু পবিত্র জাতীয় সংসদে এ ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপনের গুরুত্ব একেবারেই অন্য মার্গের। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা যাদের হাতে সেই জনগণ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করেন জাতীয় সংসদে তাদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সাংসদদের মাধ্যমে। কাজেই সাংসদরা যখন জাতীয় সংসদে কোন প্রস্তাব উপস্থাপন করেন তাতে দেশের জনগণের প্রত্যাশার অনুরণন থাকে। আর সেই সাংসদরা যদি হন সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতীকে নির্বাচিত, তখন জাতীয় সংসদে তাদের বক্তব্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বক্তব্য হিসেবেই পরিগণিত হয়। এত গেল একটি দিক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে- এই প্রস্তাবটি উত্থাপনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় ফিরিয়ে আনায় আর আগামীর বাংলাদেশের সামনে ইতিহাসটা ঠিকঠাক মতো তুলে ধরায় আমাদের দায়িত্ব পালনে আরেকটি ধাপ এগিয়ে গেলাম। মিথ্যার বেসাতী আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভুল ইতিহাস শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের বিভ্রান্ত প্রজন্মের বাঙালী বানানো হয়েছিল। আমার সুকন্যা-সূর্য অন্তত সেই বিভ্রান্তির চোরাবালিতে পথ হাতড়ে ফিরবে না।

তবে এও বুঝি যে এটি একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হবে। ’৭৫-এর নেপথ্যের কুশীলবদের শনাক্ত করার জন্য সরকার এরই মধ্যে একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রীতি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক একটি সেমিনারে মাননীয় আইনমন্ত্রী বিষয়টি দেশবাসীকে জানিয়েছেনও। কমিশন চিহ্নিত করবে নেপথ্যের খলনায়কদের। তারপর শুরু হবে তাদের বিচারের প্রক্রিয়া। তার আগে প্রয়োজন হবে প্রচলিত আইনের সংস্কারের। কারণ আমাদের প্রচলিত দ-বিধিতে মরণোত্তর বিচারের বিধান নেই। আমাদের দেশে নেই বলে যে কোথাও নেই তা কিন্তু নয়। ইতালির মতো উন্নততম দেশেও মরণোত্তর বিচারের বিধান রয়েছে। আমি নিশ্চিত, সমস্ত প্রক্রিয়া শেষে একদিন ঠিকই এদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্যর। সেই প্রস্তুতিও আমাদের আছে। আমারা দেখেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকা-ের বিচারের জন্য কি অসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু যতটুকু এখনই করা সম্ভব তা বাস্তবায়নে বাধা কোথায়? আর কেনই বা অপেক্ষা?

মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট আমাদের সংবিধানের রক্ষক, এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদও যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোন আইন প্রণয়ন করেন তবে তা বাতিলের ক্ষমতা রাখে দেশের এই সর্বোচ্চ আদালত। স্বাধীন বাংলাদেশে এর একাধিক উদাহরণ আমরা দেখেছি। সেই সুপ্রীমকোর্টের রায়ে এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ ছিল এদেশের অবৈধ শাসক। তাই যদি হবে তবে বঙ্গভবনের যে কক্ষটিতে এদেশের একের পর এক রাষ্ট্রপতির ছবি ঝোলানো আছে সেখান থেকে এই দুই অবৈধ শাসকের পোর্ট্রেট দুটি নামিয়ে আনায় কিসের দ্বিধা। তাদের শাসনের কলঙ্কিত অধ্যায় আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলব না ইতিহাসেরই স্বার্থে। কিন্তু তাই বলে এই দুই লাঠিয়াল শাসকের দেয়ালে ঝোলানো পোর্ট্রেট কি আমাদের দেশের সবচাইতে ঐতিহ্যবাহী ভবনটির মর্যাদাহানি করছে না? আমরা কি ভুল সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছি না আমাদের আগামীর প্রজন্মকে। আর সবচেয়ে বড় কথা, পুরো দেশ আর পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাঙালীরা যখন মাতছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে তখন বঙ্গভবনে তার পবিত্র পোর্ট্রেটের পাশে অমন দুষ্কৃতকারীদের ছবি ঝুলতে থাকাটা কি বড্ড বেশি বেমানান নয়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here