খবর৭১ঃ পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। বিচার চেয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না ভুক্তভোগী পরিবার। অনেক ক্ষেত্রে বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করার পর পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে হুমকি। এ কারণে পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিচার প্রত্যাশা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পুলিশি নির্যাতনে আহত হলেও ভুক্তভোগীরা মামলা করেন না। তবে এ সব ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে বলে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যুত, পদোন্নতি স্থগিত ও পদাবনতির মতো শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালেই সারাদেশে পুলিশের হেফাজতে ১৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে গ্রেফতারের আগে নির্যাতনে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্রেফতারের পর শারীরিক নির্যাতনে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। থানার হাজতখানায় দুই জন আত্মহত্যা করেন। দুই জন অসুস্থ হয়ে মারা যান। বাকি দুই জন নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন,‘সম্প্রতি উত্তরা পশ্চিম থানা ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনা দুটি তদন্তেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মৃত্যুর অভিযোগটি হচ্ছে আত্মহত্যা। তবে তার আত্মহত্যায় কারো প্ররোচনা রয়েছে কি না সে বিষয়টিও আমি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। তদন্ত রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘হেফাজতে মৃত্যু নানা কারণে হতে পারে। নির্যাতনের অভিযোগ যেমন উঠে আসে, তেমনি অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুর উদাহরণও রয়েছে। হেফাজতে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে কখনো কখনো। পুলিশি হেফাজতে যে কারণেই মৃত্যু ঘটুক না কেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা পুলিশ সদস্যদের কোনো গাফিলতি, বিচ্যুতি বা অপরাধ প্রমাণিত হলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হ?য়।’
সর্বশেষ গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার হাজতে আবু বক্কর সিদ্দিক বাবু (৩৫) নামে একজন আসামি মারা যান। পুলিশ বলছে, ঐ আসামি হাজতের গ্রিলের সঙ্গে চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে গ্রিলের সঙ্গে চাদর পেঁচিয়ে আত্মহত্যার বিষয়টি মানতে রাজি নন নিহত বাবুর সহকর্মীরা। বাবু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) ফ্লোর ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একজন নারী ডিজিটাল নিরাপত্তা ও নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেছিলেন। ঐ মামলাতেই গত ১৮ জানুয়ারি রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বাবুর মৃত্যুর ঘটনার বিচার চেয়ে এফডিসির সহকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। ঘটনাটি তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ গাড়িচালক আলমগীর হোসেনকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায়। থানায় রেখে রাতভর মারধর করা হয় তাকে। থানা থেকে মুক্তি পেতে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয় বলেও অভিযোগ করেছে তার পরিবার। পরে তার কাছ থেকে ৮০ পিস ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে মাদক আইনে একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ঐ মামলায় পুলিশ তাকে আদালতে পাঠায়। আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সময় তিনি পড়ে যান। তার দুই পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কারাগারে আলমগীর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯ ডিসেম্বর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিত্সকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকার আদালতে মৃতের স্ত্রী আলেয়া বেগম বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা, এসআই মো. মিজানুর রহমান, এএসআই নামজুল ও মো.সোহাগকে আসামি করে মামলা করেছেন।
মামলার বাদী অভিযোগ করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর থেকে অজ্ঞাত মোবাইল ফোন নম্বর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মামলা তুলে না নিলে তার পরিণতি স্বামীর মতোই হবে।
গত ১৯ নভেম্বর নরসিংদীতে জেলা ডিবি পুলিশের হেফাজতে ইউসুফ মিয়া (৩৫) নামে এক আসামির মৃত্যু হয়। ৪ নভেম্বর নরসিংদীর ঘোড়াশালে পাঁচটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি হয়। এ ঘটনায় মাধবদীর বিরামপুর এলাকা থেকে ইউসুফ মিয়া ও রোকসানা বেগম নামে দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদে ইউসুফ ডাকাতির কথা স্বীকার করে। ডাকাতির মালামাল উদ্ধার করতে গেলে ইউসুফ মিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে চিকিত্সার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর সময় রাস্তায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জ সদর থানা পুলিশের হেফাজতে ৪৫ হাজার টাকার চেক ডিজঅনার মামলার আসামি ফারুক মিয়ার (৪৮) মৃত্যু হয়। ঐদিন গভীর রাতে পুলিশ বাসায় অভিযান চালিয়ে ফারুককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ঘণ্টা দুয়েক পর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ফারুক অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। ফারুকের ভাই আব্দুল মতিন হাসপাতালে গিয়ে ফারুকের লাশ দেখতে পান। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পাশাপাশি দুই হাতের কনুই ও দুই পায়ের আঙুল থ্যাঁতলানো ছিল। ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিষয়টি তদন্ত করে পুলিশ জানায় যে ফারুককে আটকের সময় পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে সে একটি উঁচু দেওয়াল টপকানোর চেষ্টা করে। এ সময় আঘাত পেলে অসুস্থ হয়ে সে মারা যায়।
ওপরের চারটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাত্র একটি ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নিহতের পরিবার। অন্য মৃত্যুর ঘটনাগুলোতে মামলা করার সাহস পাননি ভুক্তভোগীরা। অথচ নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী কেউ নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে অভিযোগ করতে পারেন। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড হতে পারে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনায় যারা বিচার চাচ্ছেন, সরকারের উচিত তাদেরকে আইনি সুরক্ষা দেওয়া। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে কাজটুকু তাদের করার কথা, সেই কাজটুকু যেন করেন। কেন তারা আগ বাড়িয়ে মানুষকে মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটাবেন? এটা কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন। যারা এর বিচার চাইছেন, তাদেরকে সরকার যেন যথাযথ সুরক্ষা দেন।