খবর৭১ঃ শীত মৌসুমের মাঝামাঝিতে আবারও বেড়েছে শীতের তীব্রতা। যদিও মৌসুমের শুরুতে দেশের ওপর দিয়ে কয়েক দফায় থেমে থেমে বয়ে গেছে মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। এখন আবার শুরু হয়েছে শীতের প্রকোপ।
ইতিমধ্যে আবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইতে শুরু করেছে, যা মাঘের শুরুতে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহে পরিণত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি)।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, শীতের অনুভূতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা রাখছে শীতল বায়ুর প্রবাহ। ঘন কুয়াশার কারণে রোববার সারাদিন রাজধানীতে সূর্যের দেখা মেলেনি। দেশের আরও বেশকিছু এলাকায় শীতের চিত্র অনেকটা একই।
অপরদিকে উচ্চবলয় পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশের তৎসংলগ্ন পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এসব কারণে সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা হ্রাস পেয়েছে। এটা আরও অব্যাহত থাকতে পারে।
রোববার সকাল ৯টায় দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল রাজারহাটে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। আর তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে মাঝারি এবং ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলে তা তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। সেই হিসাবে দেশে কোথাও কোথাও মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বিরাজমান।
বিএমডির আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া উচ্চচাপ বলয়ের বিস্তার বাংলাদেশেও বিস্তার লাভ করেছে। শীতল বাতাসের প্রবাহ অব্যাহত আছে। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের মুখ দেখা যায়নি।
এসব কারণে ধরণী কিছুটা শীতল আছে। আগামী ৩-৪ দিন এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। এতে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিতে পারে।
এদিকে শীতজনিত রোগে গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত) আরও ৪ হাজার ১৯০ জন আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে এ সময়ে এসব রোগে কারও মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম) ডা. আয়েশা আক্তার যুগান্তরকে জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ২৯৬টি উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, এই সময়ে ৪ হাজার ১৯০ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এর মধ্যে রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৭৩৩ জন, এআরআই-এ (একিউট রেসপারেটরি ইনফেকশন) আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৭০১ জন এবং অন্যান্য রোগে (জন্ডিস, আমাশয়, চোখের প্রদাহ, চর্মরোগ ও জ্বর) চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৭৫৬ জন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন, জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এবং পরিচালকদের বরাত দিয়ে ডা. আয়েশা জানান, ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৪৪ জন, এআরআই আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৭ হাজার ১৯৫ জন এবং অন্যান্য রোগ যেমন জন্ডিস, আমাশয়, চোখের প্রদাহ, চর্মরোগ এবং জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৬২ হাজার ২৭৯ জন।
এ সময়ে এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে এআরআই-এ ২০ জন, ডায়রিয়ার ৪ এবং অন্যান্য রোগে ৩০ জন।
শীতজনিত রোগ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান বলেন, তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন জীবাণুগুলো শীতকালে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এ সময় এরা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ও মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটায়। ফলে এ সময় বিশেষ ধরনের রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রংকিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস, চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
পাবনায় হাসপাতালে ভর্তি দু’শতাধিক : পাবনা প্রতিনিধি জানান, প্রচণ্ড শীতে জীবনযাত্রা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে পাবনায়। পদ্মা-যমুনা নদীবেষ্টিত এ অঞ্চলে গত ৭ দিন ধরে প্রচণ্ড শীত এবং হিমেল হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে প্রকৃতি ঢাকা থাকছে ঘন কুয়াশায়।
সন্ধ্যার পরে নিতান্তই কোনো কাজ ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। এক সপ্তাহ ধরে সারাদিন সূর্যের দেখা তেমন মিলছে না। দুপুর ১২টা পর্যন্ত মহাসড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলছে।
শীতের সঙ্গে হিমেল হাওয়া জনজীবনকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। শীতে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের ও চরাঞ্চলের মানুষ পড়েছেন চরম বিপাকে। প্রচণ্ড শীতে তারা ঠিকমতো কাজে বের হতে পারছেন না। স্থানীয় আবহাওয়া অফিস জানায়, এক সপ্তাহ ধরে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা ৮ থেকে ৯ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে।
ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিস জানায়, রোববার সেখানে তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়। এর আগে শনিবার ছিল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। আবহাওয়া অফিস আরও জানায়, শীতের প্রকোপ আরও বাড়বে।
এদিকে শীতে এ অঞ্চলে দুস্থ মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্রের সংকট দেখা দিয়েছে। পাবনার জেলা প্রশাসন থেকে ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার কম্বল পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দকৃত কম্বল অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেন ইউপি চেয়ারম্যানরা।
রোববার বিকাল ৫টা পর্যন্ত পাবনা জেনারেল হাসপাতালে দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু ভর্তি হয়েছেন। পাবনার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. কেএম আবু জাফর জানান, জেলার ৮টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শীতজনিত রোগে অন্তত ৫০ জন ভর্তি হয়েছে। এদিকে জেলার নিম্ন আয়ের মানুষগুলো শহরের পুরাতন গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় করছেন গরম কাপড় কিনতে।
উত্তরের জনপদে শীতের তীব্রতা : দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, ঘন কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে দিনাজপুরসহ দেশের উত্তর জনপদ। পাশাপাশি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ আর হিমেল বাতাসে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই জনপদে আবারও বাড়তে শুরু করেছে শীতের তীব্রতা।
আবহাওয়া অফিস বলছে, বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে কুয়াশা। রোববার ভোর থেকেই ঘনকুয়াশায় ঢাকা পড়ে দিনাজপুরসহ উত্তরের জেলাগুলো। দিনভর থাকে থাকে এই কুয়াশা। ফলে দিনভর সূর্যের তেমন দেখা মেলেনি।
দুপুরের পর সূর্য একটু উঁকি দিলেও তার প্রভাব তেমন বেশি ছিল না। ঘনকুয়াশার কারণে সড়ক ও মহাসড়কে প্রায় দিনভর যানবাহন চলে ঝুঁকি নিয়ে ও হেডলাইট জ্বালিয়ে।
ট্রাক ড্রাইভার মমতাজ আলী জানান, সকালে পঞ্চগড় থেকে পাথরবোঝাই ট্রাক নিয়ে রওনা হয়েছে ঢাকা অভিমুখে। কিন্তু দিনাজপুর আসছে কয়েক ঘণ্টা ধরে। ঘন কুয়াশার কারণে বেশি জোরে ট্রাক চালানো যাচ্ছে না।
দিনের বেলাতেও চলতে হচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে, সতর্কতার সঙ্গে। ঢাকা পৌঁছতে কত সময় লাগে, কে জানে। ঘনকুয়াশার পাশাপাশি হিমেল বাতাস ও মৃদু শৈত্যপ্রবাহের কারণে আবারও বাড়তে শুরু করেছে শীতের তীব্রতা।
কনকনে শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এই অঞ্চলের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। শীতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষ। তীব্র শীতে বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ।
দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জানান, বাতাসে জলীয় বাষ্প বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘন কুয়াশা বিরাজ করছে। রোববার বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৯৯ শতাংশ।
আর গতকাল দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে গতকাল রোববার দেশের সর্বোত্তরের উপজেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শীতের কারণে দিনাজপুরসহ এই অঞ্চলে বেড়েছে শীতজনিত রোগ। বয়স্ক ও শিশুরা হাঁপানি, নিউমোনিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভিড় করছে হাসপাতালে।