খবর৭১ঃ ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আমি কলকাতায়। এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়া। প্রথম জানতে পারলাম অনুজপ্রতিম সাংবাদিক অঞ্জন রায়ের ইনবক্স করা মেসেজে। কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ বলে দৈনিক সংগ্রামের শিরোনামটির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন অঞ্জন। সঙ্গত এবং যৌক্তিকও নিঃসন্দেহে। তাতেই ক্ষেপেছে জামায়াতীরা। অঞ্জনের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধারের যজ্ঞ চলছে ফেসবুকে।
সকালে ঢাকায় ফিরে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা প্রেসক্লাব। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আর বিজয় দিবসকে পেছনে-সামনে রেখে ১৫ ডিসেম্বর সম্প্রীতি বাংলাদেশের সেমিনার ওখানে। উদ্দেশ্য সম্প্রীতি, বঙ্গবন্ধু আর বাঙালীর বিজয়কে উদ্যাপন করা। সেমিনার আলো করে প্রধান অতিথির আসন অলংকরনে সম্মতি দিয়েছেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারীর’ আব্দুল গাফফার চৌধুরী। সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব হিসেবে আমার দায়িত্ব সেমিনারটা সঞ্চালন করা। আমার জন্য এটি অবশ্য নতুন কোন কাজ নয়। এ কাজ আমি বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক নানা সেমিনারে নিত্যই করে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। যাকে বলে ‘নান আদার দেন গাফফার চৌধুরী!’ ধমনীতে এড্রেনালিনের উচ্চ মাত্রাটা সহজেই বুঝতে পারছি। ওদিকে দৈনিক সংগ্রামের বিষয়টা নিয়ে মনে এক ধরনের অস্বস্তিও কাজ করছে। অবশ্য এর মধ্যেই জেনেছি রুখে দাঁড়িয়েছে আমাদের আগামীর প্রজন্ম। গ্রেফতারও করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সম্পাদককে।
এই দৈনিক সংগ্রামে ১৯৭১ এর প্রতিটি দিন বাংলাদেশ আর মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হতো। এই পত্রিকায় সে সময় যুদ্ধাপরাধীদের প্রাত্যহিক কর্মকা-ের যে আমলনামা ছাপা হতো তা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একাত্তরে জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ইত্যাদি ইসলামপন্থী দলগুলো সরাসরি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশ নিয়েছিল। কাজেই জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই দাঁড়াবে তাতে আর আশ্চর্য কি?
চর্যাপদ থেকেও যদি আরম্ভ করি, বাঙালীর এই যে হাজার বছরের ইতিহাস, এই লম্বা পথপরিক্রমায় কোথাও কোন দিনও বাঙালীর কোন স্বাধীন ভূখ- ছিল না। এটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা যে বাঙালীকে শাসন করেছে বাঙালী ছাড়া আর সবাই। দীর্ঘ এই তালিকায় আছে আরব, পারস্য আর এমনকি আফ্রিকার ক্রীতদাস আর ইংরেজ বেনিয়াও। শুধু নেই কোন বাঙালী। পালদের সময় বাংলা আর বাঙালী সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছিল অনেক। কিন্তু তারা যে বাঙালী ছিলেন না, এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ঐকমত্যই বেশি। যে সিরাজ উদ্দৌলাকে আমরা ছোটবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলে চিনতে শিখে এসেছি, তিনিও না কথা বলতেন বাংলায়, না পড়তে পারতেন বাংলা।
আর হালে চারদলীয় জোট সরকারের সময় যে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীকে আমাদের জাতির পিতা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল তিনিও ছিলেন একজন আরব শাসক মাত্র। ‘বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাঙালীর প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন বাঙালী শাসক’-এর বাইরে আর কোন ঐতিহাসিক বাস্তবতা নেই। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। কোন গণমাধ্যমের জরিপে কি ফলাফল আসল তা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। অতটা খর্বকায় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু ছিলেন না।
হাজার বছরের শাসনের নামে শোষণেও যে জাতি ফুরিয়ে যায়নি, যাকে শাসন আর শোষণের আগ্রহে এতটুকুও ঘাটতি ঘটেনি একের পর এক ঔপনিবেশিক শাসকের, সেই জাতি যখন বঙ্গবন্ধুর মতো একজন গণমানুষের নেতার নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগের মতো একটি গণমুখী রাজনৈতিক দলের সরকারের অধীনে স্বাধীন হয়, তখন সেই স্বাধীন রাষ্ট্রটি যে উন্নতির পথে না হেঁটে, বরং উন্নয়নের মহাসড়কে দৌড়াবে সেটাই তো প্রত্যাশিত এবং বাহাত্তর থেকে কার্যত হয়েও ছিল তাই-ই। বঙ্গবন্ধুর শাসনে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির দেশে।
সঙ্গত কারণেই পাকিস্তান যেমন চায়নি এমন একটি লোভনীয় ভূখ-কে হাতছাড়া করতে, তেমনি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর বাঙালীর নেতা থেকে বঙ্গবন্ধুর বিশ্ব নেতা হয়ে ওঠাটাও অনেকের কাছে ছিল অপছন্দের। বাংলাদেশের জন্মের জঠর যন্ত্রণা তাই ছিল এত বেশি তীব্র। দৈনিক সংগ্রামের সেদিনের ভূমিকার কারণ তো এ থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু এখন কেন? আবার কেন? এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন প্রেসক্লাবে পৌঁছে গেছি। ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম।
যথারীতি চলছে সম্প্রীতি বাংলাদেশের সেমিনার। শহীদকন্যা ডাঃ নূজহাত চৌধুরী বরাবরের মতোই অসাধারণ বাগ্মিতায় তার সূচনা বক্তব্যে সেমিনারের টোনটা সেট করে দিয়েছেন। সেমিনারের শেষ পর্যায়ে প্রধান অতিথি জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরীর পালা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকি। আর হঠাৎ করেই না মেলা হিসাবগুলো মিলতে শুরু করে একের পর এক। সবকিছুই খুব বেশি স্পষ্ট আর স্বচ্ছ হয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে একদিনে জন্ম দেননি। পাশাপাশি আওয়ামী লীগও তো রাতারাতি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেয়ার পরিপক্বতা অর্জন করেনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিকাশ আর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল একটি লম্বা প্রক্রিয়ায় ফসল।
নানা ক্রিয়া-বিক্রিয়া আর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশের জন্ম। আওয়ামী লীগের ইতিহাসই তাই বাংলাদেশের ইতিহাস। এ দুইয়ের বেড়ে ওঠা আর পরিপক্বতা একই সঙ্গে এবং অভিন্ন। আওয়ামী লীগের নাম এক সময় ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। আজকের অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের সাথে তার পার্থক্য যোজন যোজনের। আর এই বাঙালীও কিন্তু একদিন দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ছিল। ‘হাত’ মে বিড়ি, মুখ’ মে পান- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, এই স্লোগান একদিন আমাদের পূর্বসূরিদের মুখেই ধ্বনিত হয়েছে এই ঢাকার রাজপথে।
স্বাধীন পাকিস্তান যে মুক্তির নয়, বরং আবারো ঔপনিবেশিক শাসনের নামান্তর মাত্র, এ কথা বাঙালীর আগে বুঝেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই আটচল্লিশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে, তার মুখের ওপর এর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্ররা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই স্বাধীন পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ তার নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেটে ফেলে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগ ছিল মূলত একটি অসাম্প্রদায়িক কিন্তু বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংগঠন। বিপ্লব নয় বরং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপোসের পথে হেঁটেছিল সেই আওয়ামী লীগ, ঠিক যেমনটি প্রত্যাশিত একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে।
হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে সময় ইস্কান্দার মির্জার রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। এতে আপত্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর জবানীতে জেনেছি, আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দীকে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে এই ইস্কান্দার মির্জাই একদিন তার পতনের কারণ হবে এবং হয়েও ছিল তাই-ই। অকালে ক্ষমতাচ্যুতির কিছুদিন পরেই বৈরুতের হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন সোহ্্রাওয়ার্দী। আর এ সময়টাতেই আওয়ামী লীগের বিবর্তনের পরবর্তী ধাপে উত্তরণ আর একই সঙ্গে বাংলাদেশেরও স্বাধীন হওয়ার পথে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া।
বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ খোল নালচে বদলে ফেলে এ সময় পুরোপুরি একটি গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের এই বিবর্তনে খাপ খাওয়াতে পারেননি সে সময়কার অনেক ডাকসাইটে নেতাই। দল ছেড়ে যান আতাউর রহমান খান আর মশিউর রহমানের মতো বড় নেতারা। আর বঙ্গবন্ধু দলের পুনর্গঠনে আস্থায় নেন একদল তরুণ তুর্কীকে। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রভাবশালী, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে অপরিচিত। এদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পাবনার ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর রাজশাহীর কামারুজ্জামানের মতোন নেতারা।
এরা প্রত্যেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুধু যে জাতীয় নেতাতেই পরিণত হয়েছিলেন তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর শরীরী উপস্থিতির অবর্তমানে তারাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একাত্তরের মুজিবনগর সরকারকে আর পরবর্তীতে জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য। তাদের সঙ্গে নিয়েই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে পরিণত করেছিলেন পুরোপুরি একটি গণমানুষের সংগঠনে। পাশাপাশি গণমানসে তারা সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন। আর এই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালী পেয়েছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশ।
আর বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রটিও ছিল এক কথায় অনন্য সাধারণ। অনন্য সাধারণ এ কারণে যে এটি একটি ‘জাতি রাষ্ট্র’, অর্থাৎ এক জাতির এক দেশ। ধর্মীয় ভিন্নতা ছাড়া একটি রাষ্ট্রের নিরানব্বই শতাংশ নাগরিকের কৃষ্টি, ভাষা আর সংস্কৃতির এমন অভিন্নতা আমাদের অঞ্চলে তো বটেই, এমনকি গোটা বিশ্বেই বিরল। এই রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যে শুধু একটি অনন্য সাধারণ রাষ্ট্রেরই জন্ম দিয়েছিলেন তাই নয়, বরং তিনি এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যার স্বপ্ন তার আগে দেখেনি এক হাজার বছরেও কোন বাঙালী। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে তার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে আওয়ামী মুসলিম লীগকে গণমানুষের আওয়ামী লীগে উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন একঝাঁক অসাধারণ প্রতিভাবান রাজনীতিবিদকে, সংগঠনটিকে নিজ হাতে পরিপক্ব করেছিলেন আর তাদের সঙ্গে নিয়ে স্বাধীন করেছিলেন বাংলাদেশকে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশ এক, অভিন্ন এবং অবিচ্ছেদ্য।
স্বাধীনতার পর থেকেই নবসৃষ্ট বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে আলাদা করে নিজেকে চেনাতে সক্ষম হয়েছিল। স্বাধীনতার ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এদেশ থেকে ফিরে যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতীয় সেনাবাহিনী। অথচ আজকের জাপান কিংবা জার্মানিতে আজও আছে মার্কিন সেনা ঘাঁটি। সেই যে কবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের সে সব দেশে শেকড় গেড়ে বসা, আজও নিজ দেশ থেকে ভিনদেশী সেনাবাহিনীকে দূর করতে পারেনি জাপান আর জার্মানির মতো পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রও। অথচ বঙ্গবন্ধু এ কাজটিই করেছিলেন কি অসাধারণ দ্রুততায়। বঙ্গবন্ধুর সময়েই বাংলাদেশ পৃথিবীর অধিকাংশর রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করে। সদস্য পদ পায় জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন আর ওআইসির মতোন বড় বড় যত আন্তর্জাতিক সংগঠনের। পঁচাত্তরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিু ছুঁয়েছিল সাত শতাংশ।
ছিয়াত্তরে বাম্পার ফলন হওয়ার কথা ছিল, প্রত্যাশা ছিল প্রবৃদ্ধি বাড়বে আরও বেশি। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ অর্জন করেছিল স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদাও। বঙ্গবন্ধুর পর ওই সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি আরেকবার অর্জন করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে তার রক্তের উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করা পর্যন্ত। আর স্বল্পোন্নত দেশের পরবর্তী ধাপ, উন্নয়নশীল দেশের ক্যাটাগরিতেও বাংলাদেশের উত্তরণও ওই শেখ হাসিনার হাত ধরেই।
অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদৃষ্টির অধিকারী বঙ্গবন্ধু জানতেন যে এতে প্রতিকূলতা, টানাপোড়েন আর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যে বাঙালী আর আওয়ামী লীগের যে বিবর্তন তা পুরোপুরি পরিশুদ্ধ হতে পারে না। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিমনা বাংলাদেশকে স্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে হলে প্রয়োজন এই বাঙালী আর সঙ্গে আওয়ামী লীগের মননের আরও বেশি স্বচ্ছতা, আরও পরিশুদ্ধতা। ত্রিশ লাখ শহীদ আর তিন লাখ বীরাঙ্গনার অসামান্য আত্মত্যাগে অর্জিত বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখ-টির ‘সত্যিকারের স্বাধীনতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ জন্য এর অন্য কোন বিকল্প ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশের গণমুখী আওয়ামী লীগের তাই প্রয়োজন ছিল আরও শুদ্ধতার। একাত্তরের অগ্নিপরীক্ষা আর তারও আগের দীর্ঘ প্রস্তুতি ও বিবর্তনে বাঙালী আর আওয়ামী লীগ শুদ্ধতর হলেও, শুদ্ধতম হয়নি। যে খন্দকার মোশতাক আওয়ামী মুসলিম লীগের আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হওয়ার পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সাইন বোর্ডটি খুলে পুরনো ঢাকায় নিজের বাসায় ঝুলিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের ঝান্ডা উড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল সেও কিন্তু একাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগেই ছিল। যেমন ছিল জিয়াউর রহমানের মতো পাকিস্তানপন্থী মুক্তিযোদ্ধা, পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধে যার ভূমিকা বীরত্বপূর্ণ হলেও একাত্তরে এই সেক্টর কমান্ডারের বন্দুক থেকে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি বুলেটও ছোড়ার সাক্ষ্য ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না।
পাশাপাশি একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে এমন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ফ্যান্টাসিতে বিভ্রান্ত হয়ে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গণমানুষের আওয়ামী লীগের গণমুখী শাসন প্রতিষ্ঠা দুষ্কর করে চলছিলেন। ছিলেন আরও বেশি বিভ্রান্তরাও। যেমন ছিল চীনপন্থী সমাজতন্ত্রীরা যারা পাকিস্তানকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিলেও, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যাদের বেশিরভাগের কাছেই ছিল ‘দুই কুকুরের লড়াই।’ যে কারণে সিরাজ সিকদাররা একাত্তরের ষোলো ডিসেম্বরের পরেও পূর্ব পকিস্তানকে স্বাধীন করার ভ্রান্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।
আবার এও সত্যি যে আওয়ামী লীগের বাইরেও এমন অনেক ব্যক্তি কিংবা সংগঠন ছিল যাদের একাত্তরের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয় আর স্বাধীন দেশকেও তাদের দেয়ার ছিল অনেক কিছুই। একটি বড় প্লাটফর্মে তাদের অন্তর্ভুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি শক্ত আদর্শিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়ায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজটা অনেক সহজ করে দিত। ছিলেন পেশাজীবী আর বুদ্ধিজীবীরাও। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সম্পৃক্ত করাটা যেমন একদিকে ছিল জরুরী, অন্যদিকে প্রচলিত প্রতীককেন্দ্রক দলভিত্তিক প্রচলিত নির্বাচনী কাঠামোয় তাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করাটা ছিল দুরূহ।
এমনিতেই সদ্য স্বাধীন দেশটাকে মেধাশূন্য করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসররা একাত্তরের ন’টি মাসে আর বিশেষ করে ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের ঠিক আগে আগে বুদ্ধজীবী হত্যাকা-ের যে উন্মত্ততা চালিয়েছিল তার মাধ্যমে তারা তাদের সেই অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অনেকখানিই সফল ছিল। একে তো মেধার ঘাটতি তার ওপর রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রের সঙ্গে মেধার দূরত্ব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় ছিল। যেমন অন্তরায় ছিল কোন কোন ক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র। একাত্তরের চেতনায় একটি সত্যিকারের গণমুখী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য পাশাপাশি আরও প্রয়োজন ছিল গণমানুষের ক্ষমতায়ন।
একটি বড় ক্যানভাসে আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা স্বাধীনতার সপক্ষের সমস্ত এলিমেন্টগুলোকে একসঙ্গে করার আসলে আর কোন বিকল্প ছিল না আর একবার তা করা গেলে, শুধুই ভালদের সেই বিশাল মিছিলে আর বিপুল কর্মযজ্ঞে জিয়া-মোশতাকরা যে বিলীন হয়ে এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে তা বঙ্গবন্ধু খুব ভালভাবেই জানতেন। তার অকাল প্রয়াণের আগে আগে তিনি এই উদ্যোগটাই নিয়েছিলেন। ক্ষমতাকে গণমানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর বিপরীতে জনগণকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে জেলা গবর্নরের পদ সৃজন করা হয়েছিল।
ব্যবস্থা করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতীকীবিহীন নির্বাচনের যেখানে রাষ্ট্র নিজ খরচে প্রার্থীকে ভোটারের কাছে পরিচিত করিয়ে দিত। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কালো টাকার প্রভাব মুক্ত রাখার এই অসাধারণ কনসেপ্টটির সুফলও বাংলাদেশ পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ জমানাতেই এই প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত একাধিক নির্বাচনে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পেশাজীবী, বুদ্ধীজীবী আর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর এই অসাধারণ প্রজ্ঞার সঙ্গে ঐকমত্যে এসেছিলেন সে সময়কার বাংলাদেশের সুস্থ চিন্তার প্রায় সব আলোকিত জন। তাই বঙ্গবন্ধু যখন মণিসিংকে বলেছিলেন যে সাইন বোর্ডটা বদলে ফেললে সবাই এক, তখন সে আহ্বানে সাড়া দিতে সময় নেননি তিনি আর সে কারণেই বাকশাল ঘোষিত হওয়ার পর বত্রিশের সামনে নেচে-গেয়ে একে বরণ করে নিয়েছিলেন পটুয়া কামরুল হাসানসহ অন্য বরেণ্যরা।
এমন একটা বিশাল প্লাটফর্মে দেশকে পরিচালিত করতে হলে, দলের আর দলীয় চিন্তার উর্ধে উঠে দেশ আর দশকে অগ্রাধিকার দিয়ে অত বিশাল ক্যানভাসে অমন শিল্পকর্ম আকতে হলে যে বিশাল উদারতা, নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ইত্যাদির প্রয়োজন হয় তার অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় কখন কোন সঙ্কীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন কিংবা বাঙালীর স্বার্থবিরোধী কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন এ কথা তার চরম নিন্দুকও বলতে পারবে না।
বাঙালীর কথা ভেবেই তিনি আপোস করেননি পাকিস্তানের সঙ্গে, পায়ে ঠেলেছিলেন অখণ্ডি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব। বাঙালীর জন্য হাজার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই তিনি দেখেননি, আদায় করে ছেড়েও ছিলেন সেটা। আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্যস্ত থেকেছেন তার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশকে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কাজে। আমাদের দুর্ভাগ্য ১৫ আগস্ট আমরা শুধু একজন রাষ্ট্র নায়ককেই হারাইনি, হারিয়েছিলাম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাকে।