খবর৭১ঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বস্ত্র খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের রফতানি আয় বৃৃদ্ধির লক্ষ্যে পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি নতুন বাজার খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি মনে করি বিশ্ব বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে টেক্সটাইল পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ খুব প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘এক জিনিস সব সময় চলে না। পোশাকের ক্ষেত্রেও
তার ডিজাইন, রং এবং সবকিছু পরিবর্তন করতে হয়।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় বস্ত্র দিবস-২০১৯’ এবং ‘বহুমুখী বস্ত্রমেলা’র উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদ্যমান পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে ‘ভ্যালু অ্যাড’ এবং দেশের রফতানি আয় বাড়াতে নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করতে হবে।’ ‘এখন বিশ্ব পোশাক বাজারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থান অধিকার করে আছে।
বাস্তবে তা বিশ্ব বাজারের মাত্র ৬.৪০ শতাংশ। তাই আমাদের এই বিষয়টিতে নজর দিতে হবে, যোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, বিশ্ব বাজারে আমাদের পণ্যের চাহিদা বাড়াতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
তিনি একইসঙ্গে বাজার সম্প্রসারণ এবং বস্ত্র খাতের প্রসারে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতাদের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব দরাদরি করে পণ্যের উপযুক্ত মূল্য আদায়েও ব্যবসায়ীদের মনোযোগী হতে বলেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী সভাপতিত্ব করেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান মির্জা আজম এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বস্ত্র খাতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৯টি সংস্থা এবং উদ্যোক্তাদের মাঝে প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার বিতরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন সিজনে বা বছরের কোন সময়ে কোন রংটা বেশি প্রভাব ফেলে- এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আমাদের উৎপাদন বহুমুখীকরণ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আশা করি আপনারা এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও গ্রহণ করবেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক পার পিস খুব অল্প টাকায় আমরা বিক্রয় করি। এক্ষেত্রে আমাদের পণ্য ক্রেতারা এক ডলার করেও যদি বাড়াত তাহলে এ খাতটা আরও উন্নত করতে পারতাম।
তিনি বলেন, যেহেতু প্রতিযোগিতার একটা ব্যাপার থাকে সেজন্য আমাদের রফতানিকারকগণ বায়ারদের সঙ্গে এই ‘বার্গেনিংটা’ করেন কিনা আমি বলতে পারব না। কিন্তু আমার মনে হয় একটু করা উচিত। বায়ার বা দেশগুলোকে বিষয়টি বলা উচিত। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে, যেসব দেশে আমাদের তৈরি পোশাক রফতানি হয় সেসব দেশ সফরে গেলে তাদের সরকারপ্রধানদের কাছে তিনি নিজে বিষয়টি তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি একা তুলে ধরলে হবে না। আপনারা যারা ব্যবসা করেন তাদেরও বোধ হয় একটু উদ্যোগ নিতে হবে।’
সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে পারেন ব্যবসায়ীরা। বিদেশি বিনিয়োগও আসবে।’
তিনি বলেন, ‘পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ এবং বিশেষ করে এর আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে বেসরকারি খাতের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাই এ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা দরকার।’
তিনি নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে রাষ্ট্রীয় খাতের দুরবস্থার কথাও এ সময় উল্লেখ করেন। সরকারপ্রধান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় খাতে গেলেই অজানা কারণে আমরা লাভের মুখ দেখি না।
জানি না এর পেছনে মূলত কী কারণ। তাই বেসরকারি খাতের দিকেই আমাদের আগ্রহ বেশি। তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’
অর্থনীতিতে বস্ত্র খাতের ভূমিকা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১৩ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৪৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, যার অধিকাংশই নারী।
পরোক্ষভাবে প্রায় ৪ কোটিরও বেশি মানুষ এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল গঠন, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, ন্যূনতম মজুরি কমিশন শক্তিশালী করা, শ্রম আইন সংশোধন ও শ্রম বিধিমালা জারিসহ শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে তার সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি উল্লেখ করেন, দেশের বস্ত্র খাতকে যুগোপযোগীকরণ, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জনে সহায়তাকরণ এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে বস্ত্রনীতি-২০১৭ এবং বস্ত্র আইন-২০১৮ প্রণয়ন এবং বস্ত্র পরিদফতরকে শক্তিশালী করে বস্ত্র অধিদফতরে উন্নীত করা হয়েছে।
দেশের বন্ধ কলকারখানা চালুতে তার সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনের ১৬টি বন্ধ মিল পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ পদ্ধতিতে চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
ইতিমধ্যে দুটি বন্ধ মিল পিপিপি’র আওতায় পরিচালনার নিমিত্তে চুক্তি স্বাক্ষরপূর্বক প্রাইভেট পার্টনারদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া ও আরব আমিরাতের সঙ্গে যৌথভাবে ৪টি কারখানা পিপিপির আওতায় চালু করার ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি এ সময় বর্ষব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপনের প্রসঙ্গ টেনে এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি এখানেই থেমে না থেকে বাংলাদেশকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যাতে একটি সুন্দর দেশ পায়, উন্নত জীবন পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা এবং শতবর্ষ মেয়াদি ‘ডেল্টা পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের উদ্যোগও তুলে ধরেন।
তিনি উল্লেখ করেন, আগামীকাল ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ১৭ মার্চ থেকে শুরু হতে যাওয়া ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপনের আনুষ্ঠানিক ক্ষণ গণনা শুরু হবে এবং ২৬ মার্চ ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন পর্যন্ত এই ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপিত হবে।
অকাল মৃত্যু সবাইকে কষ্ট দেয় -প্রধানমন্ত্রী : প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু অকাল মৃত্যু সবাইকে কষ্ট দেয়। একে একে আমাদের কাছের মানুষরা চলে যাচ্ছেন।
যারা চলে যাচ্ছেন তারা প্রত্যেকেই দেশের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের ষষ্ঠ অধিবেশনের প্রথম দিনে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও অংশ নেন- বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বি মিয়া, বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা, গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, সরকারি দলের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত, আবুল কালাম আহসানুল হক চৌধুরী ও খালেদা খানম।
শোক প্রস্তাব উত্থাপনের পর মরহুমদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত ও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর চলতি সংসদের সদস্য ডা. ইউনুস আলী সরকারের মৃত্যুতে রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদের অধিবেশন এক ঘণ্টার জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে সংসদে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডা. ইউনুস আলী অত্যন্ত অমায়িক মানুষ ছিলেন। তিনি হেঁটে হেঁটে এলাকাসহ মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতেন। অসহায় মানুষদের নিজের টাকায় ওষুধ কিনে দিতেন।
এমন একজন মানবতাপ্রেমী মানুষ এভাবে অকালে চলে যাবেন, তা কল্পনাও করতে পারিনি। আর দু’বারের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি অত্যন্ত ভালো একজন বক্তা ছিলেন।
ভবিষ্যতে তার একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় আমার মামলার কাজের সঙ্গে সে জড়িত ছিল। অত্যন্ত মেধাবী ছিল বাপ্পি। তার এ অকাল মৃত্যু মেনে নেয়া খুবই কঠিন।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ফজলে হাসান আবেদের স্ত্রী আমাদের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। আমি তাকে ইউনিভার্সিটি ও একটি ব্যাংক করতে অনুরোধ করেছিলাম।
পরে তাকে ব্যাংক দিয়েছিলাম। তার কাজের ফলে পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। সদ্য প্রয়াত সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মুহাম্মদ জয়নুল আবেদিনের প্রতিও শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী।