খবর৭১ঃ ক্যাসিনো–টেন্ডারবাজি–আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অপরাধের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া শুদ্ধি অভিযান থমকে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, শীর্ষ পর্যায়ের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছে তারা। এই শুদ্ধি অভিযান আর এগোবে কি না, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই সন্দিহান।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে শুদ্ধি অভিযানের শুরু। সবশেষ ৩১ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মঈনুল হককে মদ, আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের পর এই অভিযান থেমে আছে। মোটের ওপর দেড় মাস ধরে চলা এই অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটসহ ১১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকেই দেশ ছাড়েন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হওয়ায় এরই মধ্যে দেশে ফিরেছেন যুবলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য মিজানুর রহমান ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ রবিউল ইসলাম।
এই অভিযান পরিচালনা করেছে র্যাব। অভিযানের উদ্দেশ্য-গতিপ্রকৃতি ও গন্তব্য সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, যুবলীগের কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও ব্যবসায়ীরা কথা বলেছেন ঠিকই, তবে নাম প্রকাশ করতে চাননি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার–বিন–কাশেম বলেন, র্যাবকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। র্যাব তার দায়িত্ব পালন করেছে। ঢাকা শহরে এখন আর কোনো ক্যাসিনো চলছে না। এর বাইরে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে র্যাবের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, শুদ্ধি অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের মুখ থেকে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসে। এই নামগুলো শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পাঠিয়ে পরবর্তী নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল মাস দেড়েক আগে। জবাব পাওয়া যায়নি।
র্যাব ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এখন নতুন তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। গত এক দশকে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকে পুঁজি করে যাঁরা বিপুল অর্থ–বিত্তের মালিক হয়েছেন এই তালিকায় তাঁদের নাম থাকবে। আর্থিক খাতে দুর্নীতিবাজদের নাম উঠছে পৃথক একটি তালিকায়। তবে এই তালিকার ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সে সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিশ্চিত নন।
তবে গত ১৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে কৃষক লীগের অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন আমরা থেমে গেছি। আমরা আসলে থেমে নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এই অভিযান চলমান রাখব। তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আমরা তথ্যভিত্তিক অভিযান চালাব। শুদ্ধি অভিযান চলমান থাকবে।’
গোড়ায় গলদ?
হঠাৎ শুদ্ধি অভিযানের পেছনে মোটাদাগে দুটো কারণের কথা বলছে একাধিক সূত্র। এই কারণগুলোর ধরন এমন, যা অভিযানকে স্থায়িত্ব দেয় না। প্রথমত, পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা আছে। এই সমালোচনার জবাবে ক্ষমতাসীন দল উন্নয়নের বিষয়টি সামনে এনেছে। কিন্তু বিভিন্ন খাতে সরকারি দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে অর্থ–বিত্তের মালিক হওয়ার অভিযোগও ওঠে। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের দুটি অংশের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এমন প্রেক্ষাপটে অভিযান শুরু হলে তা প্রশংসিত হয়। কিন্তু মাস দেড়েকের মাথায় এ অভিযান থেমে যায়।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যুবলীগ বহু বছর ধরেই আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার অনুগত, পুলিশ প্রশাসনের ওপরও তাঁর প্রভাব আছে। ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সভাপতি সম্রাট কী করছিলেন, সেটা কারও অজানা ছিল না। হঠাৎ করে সম্রাটসহ যুবলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ওই নেতাকেই বার্তা দেওয়ার একটা চেষ্টা করা হয়েছে বলে ধারণা তাঁর।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রগুলো বলছে, অভিযানের সময় অনেকের নাম আলোচনায় এলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যেমন, যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাবেক দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান, যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী ওরফে শাওনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওই সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক ও তাঁর ভাই রূপন ভূঁইয়া। ক্যাসিনো ব্যবসায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওছারের নাম ছিল আলোচনায়, দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও তাঁর ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে, এমন কোনো খবর নেই। জি কে শামীমকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করা হলে তিনি প্রথমেই মোল্লা আবু কাওছারের খোঁজ নিয়েছিলেন।
পুলিশ বলছে, কোথাও কোথাও অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন আছে। দুজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, মোহাম্মদপুরে পরিচালিত অভিযানের সঙ্গে শুদ্ধি অভিযানকে মেলানো যাবে না। এই অভিযান ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকেন্দ্রিক। কলাবাগান ক্লাব সূত্র ও ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত আছে এমন একাধিক ব্যক্তি বলেন, কয়েক বছর আগে ক্যাসিনো ব্যবসা করতেন ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন ওরফে সেন্টু। তাঁকে হটিয়ে ক্যাসিনো বন্ধ করে দেন কৃষক লীগের নেতা সফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ। কিন্তু তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটছেন। কলাবাগান ক্লাবের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্তও হয়েছে।
আস্থার সংকটঃ
আস্থার সংকটে অভিযান গতি হারিয়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ। অনেকের ধারণা, এই অভিযান রাজনীতিবিদ বনাম আমলাদের দ্বন্দ্বের ফল। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, এ অভিযান অপরিকল্পিত। আমলাদের পরামর্শে রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের ঘায়েল করার একটা চেষ্টা। প্রথমে অভিযান হলো। এখন আওয়াজ উঠেছে দল থেকে সরকারকে আলাদা করতে হবে। যাঁরা এই আওয়াজটা তুলেছেন তাঁরা চান পুরোনো রাজনীতিবিদেরা মন্ত্রিসভায় না থাকুক। আসলে অভিযান থমকে যাওয়ার কারণ, তদন্তে প্রচুরসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তার নাম বেরিয়ে আসছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কাউন্সিলর বলেন, এমন একটা সময়ে কাউন্সিলরদের ধরপাকড় শুরু হলো, যখন সিটি করপোরেশন নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। তাঁকেও অনেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
জানা গেছে, জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তার নাম বলেছেন জি কে শামীম। এর সূত্র ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন ১১ জনকে তলব করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, শামীম গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন। রফিকুলকে র্যাব কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। কিন্তু দুদক যাঁদের ডেকেছে, সেই তালিকায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের নাম নেই।
তবে স্বরাষ্ট্রসচিব মোস্তফা কামালউদ্দীন বলেন, সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের নাম আসায় অভিযান থমকে গেছে, এমন অভিযোগ অসত্য। তিনি বলেন, শুদ্ধি অভিযান একটা চলমান প্রক্রিয়া। বছরজুড়েই দুর্নীতি দমন কমিশন, কর বিভাগ তাদের কাজ করে যায়। সরকারি কর্মকর্তাদের ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। ক্যাসিনো একটা ইস্যু ছিল, সেটাকে সামনে রেখে বিশেষ অভিযান চলেছে। আবারও এমন কোনো ইস্যু এলে অভিযান হবে।
অন্যদিকে কোনো কোনো রাজনীতিবিদের ব্যাপারে অভিযোগের শেষ নেই। পুলিশ ও র্যাবের লোকজন বলছেন, বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা কী করছেন সেটা তাঁরা জানতেন। কিন্তু তাঁদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে গেলে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যুক্ত র্যাবের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সম্রাট জিজ্ঞাসাবাদে কাকে কত টাকা দিতেন তা বলেছেন। তিনি স্থানীয় এক নেতাকে নির্বাচনের আগে ৭৫ লাখ টাকা দেন। নির্বাচন শেষে তিনি আবার ২৫ লাখ টাকা চেয়ে পাঠান। শুদ্ধি অভিযানে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই রাজনৈতিক দলের নেতাদের টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, দুর্নীতি যে–ই করুক, সবার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দীন খান বলেন, ‘অভিযানটা কি পরিত্যক্ত হয়ে গেল? আমার তো তাই মনে হচ্ছে এখন। শুরু থেকেই অভিযানটা অপরিকল্পিত ছিল। এখান থেকে এক খাবলা, ওখান থেকে এক খাবলা—এভাবে গ্রেপ্তার করে তো আর শুদ্ধি অভিযান সফল হয় না। আর ক্যাসিনো ছাড়া কি অন্য কোনো খাতে দুর্নীতি হয়নি? সেই খাতগুলোকে ধরা হচ্ছে না কেন?’
সূত্রঃ প্রথম আলো