খবর৭১ঃ সদ্য বিদায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। সবশেষ নভেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আগের বছরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ছিল ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ব্যাংকের তারল্য সংকট, উচ্চ ঋণের সুদহার ও অবকাঠামোগত সমস্যা এবং নতুন বিনিয়োগের অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চলার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বেশি সুদে সঞ্চয়পত্রে আমানত চলে যাওয়ার কথা। তাই চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। আবার উচ্চ সুদহারের কারণে ঋণ নিতে আগ্রহী নন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা। ফলে গত কয়েক মাসে আমদানিও কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের নভেম্বরের তুলনায় ২০১৯ সালের নভেম্বর বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগের মাস জুলাই শেষে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ, জুন মাসে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ, এপ্রিলে ১২ দশমিক ০৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ।
জানা গেছে, চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করেছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। যা গেল অর্থবছরের জুন পর্যন্ত লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছর (জুলাই-জুন) পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ।
ব্যাংক ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির এই ক্রমাবনতির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে খুব বেশি আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ, ঋণের সুদহার দুই অঙ্কের ওপরে। এ ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিও মন্থর হয়ে গেছে। তাতে কমছে রপ্তানি আয়ও। এ কারণে ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদা কিছুটা কমে গেছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রক্ষেপণ ছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু গত জুন শেষে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এটি গত অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম। এখন বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কমেছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ মাস নয় দিনেই (১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছে সরকার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৯ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে (১ জুলাই থেকে ৩০ জুন) ব্যাংক থেকে সরকারের যে টাকা ধার করার কথা ছিল তার পুরোটাই পাঁচ মাসে নিয়ে ফেলেছে।
সবমিলিয়ে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি বেসরকারি খাতের ঋণ হু হু করে বাড়ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতে সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। ফলে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ২০১৮ সালের শুরুতেই ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কিছুটা কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপর থেকে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে।
এরপর কয়েক দফা এডিআর সমন্বয়ের সীমা বাড়ানো হলেও নানা কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। নিম্নমুখীর ধারা অব্যাহত আছে। তবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডিআর হার বাড়িয়ে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই আগামীতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
এবিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে। তারা আমানত পাচ্ছে না। যার কারণে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। এ ছাড়া যেসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারাও ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে খুব যাচাই-বাছাই করছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ কমে গেছে।’
এভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ ধারাবাহিক কমতে থাকলে ভবিষ্যতে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আহসান এইচ মনসুর। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ না বাড়লে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে উন্নয়ন হবে না। যেকোনো মূল্যে সরকারকে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।’