খবর৭১ঃ
জয় বাংলা বাঙালীর জাতীয় স্লোগান। এই স্লোগান মুখে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানের দখলমুক্ত করেছিল বাংলাদেশকে। জয় বাংলা তাই আর দশটা স্লোগানের মতো সাধারণ কোন স্লোগান নয়।
আমার লেখায় আর বলায় প্রায়ই বাঙালীর ইতিহাসকে টেনে আনি। বাঙালীর যে হাজার-হাজার বছরের ইতিহাস, এমনকি চর্যাপদ থেকে শুরুটা ধরলেও ন্যূনতম যা এক হাজার বছরের, তাতে কিন্তু বাঙালীর কোন স্বাধীন রাষ্ট্র কিংবা সার্বভৌম বাঙালী শাসকের উল্লেখ নেই। বাঙালী বরাবরই শাসিত ও শোষিত হয়েছে, তা সে আরব হোক আর ব্রিটিশ হোক, কিংবা সিরাজ হোক আর সেন হোক। ইতিহাসে বাঙালীর প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ আর তাদের প্রথম স্বাধীন শাসক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক বাস্তবতা এটাই। আর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে, তার নেতৃত্বে বাঙালী যে স্লোগান মুখে নিয়ে এই ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল, তা হলো ‘জয় বাংলা’।
স্বাধীন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সম্প্রতি রায় দিয়েছে, ‘জয় বাংলা’ আমাদের জাতীয় স্লোগান। এবারের বিজয় দিবস থেকে রাষ্ট্রীয় যে কোন অনুষ্ঠানে জয় বাংলা বলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ে। আর দশজন বাঙালীর মতোই এই রায়ে উল্লিসিত আমিও। প্রাণ খুলে গাইতে ইচ্ছে করছে ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা … …!’ আর সেই বিচারে বিচারপতিরা পূর্ণ নম্বর পেয়ে পাস করেছেন। কিন্তু তারপরই একটু খটকা লাগে। প্রাণ খুলে গানতো বেশ গাইছি, ভাবছি কি একটিবারও -যে স্লোগান আমাদের অস্তিত্বের মূলে, সেই স্লোগানের জন্য আদালতের রায়ের প্রয়োজন কেন পরে?
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের এগিয়ে চলা যেমন সহজ ছিল না, তেমনি সহজ ছিল না জয় বাংলার পথ চলাও। নির্বাসনে ছিল জয় বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশে দুই দশকেরও বেশি সময়। পাকিস্তানের পা চাটা বাংলাস্তানীরা পাকিস্তানের অনুসরণে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ প্রচলন করেছিল। ১৯৯৩ কিংবা ১৯৯৪ সালের ঘটনা। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে আমরা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ক্যাম্পাসে ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারের চেষ্টা করেছিলাম। এই অপরাধে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ক্যাডাররা আমাদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালিয়েছিল ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে আর ছাত্রাবাস-এ তো বটেই, এমনকি ছাত্রী হোস্টেলেও। শুধু তাই নয়, ’৯১-এ জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কৃত হয়ে আমরা ক্যাম্পাসের আশপাশে যেসব বাসাগুলোয় ভাড়া থাকতাম, সেগুলোতেও হামলা চালানো হয়েছিল। রামদা’র কোপে আহত হয়েছিলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সেসময়ের একাধিক নেতাকর্মী। ছাত্রদলের সঙ্গে অবশ্যই ছিল ছাত্রশিবির, ছিল এমনকি বাম’রাও। সেসময়কার অদ্ভুতুরে বাস্তবতায় ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদে ছিল বামেরাও।
ডান-বাম-এর সেই রহস্যময় আঁতাত আজও সক্রিয়। জয় বাংলাকে আর জয় বাংলা’র মানুষগুলোকে আবারও আঁস্তাকুড়ে পাঠানোয় তারা এখনও তলে-তলে সক্রিয়। এরা অনেকেই এখন ‘দুধ খেয়ে গোঁফ মুছে’ জয় বাংলার ভিড়ে মিলে মিশে আছে। মাঝে-মাঝেই তাদের আমরা স্বরূপে দেখি। এই তো ক’দিন আগেও আমার যে কর্মস্থল, জাতির পিতার নাম ধারণ করে এগিয়ে চলেছে দেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র সক্রিয় যে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়টি, সেখানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণে বাধা দেয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের বড় নেতা। এই ঘটনার সাক্ষী শত শত।
আদালতের একটি আদেশে যেমন জয় বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় না, তেমনি আওয়ামী লীগের ক্ষমতার টানা তিনটি মেয়াদও কিন্তু স্বাধীনতার সপক্ষের আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের গ্যারান্টি দেয় না। সে কারণেই নয়াপল্টনে প্রেস কনফারেন্স করে ‘তারা’ বড় গলায় বলার ধৃষ্টতা দেখায় যে, তাদের সময় নাকি এদেশে কোন হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি!
জয় বাংলাকে যদি সুরক্ষিত রাখতে হয়, যদি নিশ্চিত করতে হয় আপনার-আমার আগামী প্রজন্মের জন্য জয় বাংলার বাংলাদেশ, তাহলে আমাদের আরও অজানা ও সচেতন হতে হবে। শুধু নিজেরটা না ভেবে আপনাকে আর আমাকে একে-অপরের দিকটাও দেখতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থে ‘দুধ খেয়ে গোঁফ মোছার’ দলকে আর প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। আন্তরিকতা দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে। আর ওই ‘গোঁফ মোছার’ দলকে বলে দিতে হবে, ‘দুধ খেয়ে গোঁফ মোছার’ দিন শেষ। এটা শুধুই জয় বাংলার বাংলাদেশ।