খবর৭১ঃ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স নিয়ে রাষ্ট্রপতির অসন্তোষ প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা জারির পর ইতিমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সান্ধ্য কোর্স বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনই বন্ধ হচ্ছে না সান্ধ্য কোর্স। এ বিষয়ে গত মে মাসে গঠিত একটি কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছে কর্তৃপক্ষ। ওই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্সের ভবিষ্যৎ।
এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান।
ভিসি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে সব দিক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে সান্ধ্য কোর্সের ব্যাপারে কমিটির কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে তিনি বেলন, ‘আশা করি শিগগির আমরা সুস্থ একটি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারব। কমিটির রিপোর্টের ওপরই এ সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।’
গত ৯ ডিসেম্বর সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত বিভিন্ন সান্ধ্য কোর্সের সমালোচনা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
তার এক দিন পর বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত বিভিন্ন সান্ধ্য কোর্স বন্ধের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স বন্ধ ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
৫২তম সমাবর্তনে সান্ধ্য কোর্সের সমালোচনা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি এবং রাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র ধারণ করে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ডিপার্টমেন্ট, ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইনস্টিটিউটের ছড়াছড়ি। নিয়মিত কোর্স ছাড়াও এসব বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে প্রতি বছর হাজার হাজার গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু লাভবান হচ্ছে এ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একশ্রেণীর শিক্ষক ঠিকই লাভবান হচ্ছে। তারা নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়।’
এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ সময়মতো পদক্ষেপ নিলে এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব হতো। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না। আমি আশা করি ভবিষ্যতে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আচার্য তথা রাষ্ট্রপতির কথা অনুশাসন হিসেবে মেনে চলে বলে জানান ভিসি। তিনি বলেন, ‘এর আগে ২০১৮ সালে মহামান্যের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকালে তিনি আমাকে এ ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা দেন। তিনি বলেছিলেন, নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব একাডেমিক কোর্স আছে সেগুলো শিক্ষার মানকে বা সার্বিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে কি না। তখনই আমি এই কথাগুলো অনুশাসন হিসেবে ব্যবহার করি। ইভনিং কোর্স চালুর ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াধীন ছিলে। সেগুলো আমি বাতিল করে দেই। তবে যেগুলো চালু ছিল সেগুলোর ব্যাপারে কী করা যায় সেটি বিবেচনা করতে বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিই। হুট করে তো কিছু করা যায় না। পরিকল্পনা করে আমাদের এগোতে হবে।’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত কিংবা কোনো কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন কোনো কাজের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট থাকবে না। নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের জায়গা। আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবনমান এবং শিক্ষার গুণগত মান উৎকর্ষের জন্য আমাদের কাছে যেগুলো ভারী মনে হবে, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপাসিটির বাইরে এবং জাতীয় ‘নিডে’ খুব অত্যাবশ্যক নয়, সে বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় কখনো ‘এন্টারটেইন’ করবে না।” বলেন উপাচার্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিজনেস অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের সান্ধ্য কোর্সে এখন ভর্তি কার্যক্রম চলছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সান্ধ্য কোর্সের ভর্তি পরবর্তী সাক্ষাৎকার শনিবার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। রাষ্ট্রপতির ক্ষোভ ও মঞ্জুুরি কমিশনের নির্দেশনায় কমিটির প্রতিবেদন আসার আগে এসব কোর্সের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘একটা প্রক্রিয়া করে এগোতে হবে। হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে একটা একাডেমিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তাই খুব সুষ্ঠুভাবে আগাতে হবে। আমাদের এটি তো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। কারও শিক্ষাজীবন যেন ব্যাহত না হয় সেটাও আমাদের দেখতে হবে। ফলে খুব সুচিন্তিত ও পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে যেন আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী ও মর্যাদাহানিকর কোনো কর্মসূচির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট না থাকে।’
কমিটির সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত সম্পর্কে উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য একটাই, যে কথাটি মহামান্য বলেছেন। এই নির্দেশনা মহামান্য আমাকে ২০১৮ সালে দিয়েছেন। সুতরাং মহামান্যের বক্তব্যের যে অনুশাসন সেটি আমরা অনুশাসন হিসেবেই গ্রহণ করি। সেই অনুশাসন মোতাবেক আমরা এগুচ্ছি। সুতরাং মহামান্যের বক্তব্যকে ‘অব্লিগ’ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
এদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগাযোগ করলে বিভাগের অফিস থেকে বলা হয়, বিভাগের যত উন্নয়ন তার বেশির ভাগই সান্ধ্য কোর্সের টাকা দিয়ে হয়। এ ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি রাখব না। আমাদের এটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারের বরাদ্দে এটি চলে। সুতরাং সরকারি অর্থ ব্যবহার করেই আমাদের এগোতে হবে। তবে এটা সত্য, সান্ধ্য কোর্সের সুবাদে বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে কিছুটা উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সেগুলো নিঃসন্দেহে সরকারও বিবেচনা করতে পারে। যুগের চাহিদার সঙ্গে যে উন্নয়ন দরকার, সে জন্য দরকার হলে বাজেট কিছুটা বৃদ্ধি করব। তবুও মূল অ্যাকাডেমিক দায়িত্ব থেকে কোনো ধরনের বিচ্যুতি বা ব্যত্যয় কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।’
অর্থ অর্জন কিংবা মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বলেন উপাচার্য। ‘নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম বেগবান করা এবং এর গুণগত মান উন্নয়নের জন্য যেটি দরকার সেটি আমরা সরকারি বরাদ্দ থেকে প্রত্যাশা করব। সুতরাং আমাদের মূল অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় বা প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’