খবর৭১ঃ
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় সংঘর্ষের ঘটনায় ‘তৌহিদি জনতা’র ছয় দফা দাবি মেনে নিয়েছে প্রশাসন। দাবি মেনে নেওয়ায় ‘সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে আজ সোমবার বেলা ১১টায় ভোলা সরকারি স্কুল মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ বাতিল করা হয়।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গতকাল রোববার ভোলার বোরহানউদ্দিনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক যুবকের বিচারের দাবিতে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে বিক্ষোভ থেকে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বলছে, এক যুবকের হ্যাক হওয়া আইডি থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার বক্তব্য ছড়ানোর ঘটনা থেকে এ পরিস্থিতির সূত্রপাত। একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত চারজনকে নিজেদের কর্মী-সমর্থক বলে দাবি করেছে তৌহিদি জনতা। সংঘর্ষে পুলিশের ১০ সদস্যসহ দেড় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
গতকাল রাতে ভোলা-২ (দৌলতখান-বোরহানউদ্দিন) আসনের এমপি আলী আজম মুকুল, বরিশাল পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম, ভোলার পুলিশ সুপার (এসপি) সরকার মোহাম্মদ কায়সার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক, বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. এনামুল হকসহ বিভাগীয় জেলার কর্মকর্তারা ‘তৌহিদি জনতা’র নেতাদের সঙ্গে বোরহানউদ্দিন থানায় মতবিনিময় সভায় বসেন। সেখানে নেতারা ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করেন।
ছয় দফা দাবি হলো:
১. জেলা ও থানা থেকে এসপি এবং ওসিদের প্রত্যাহার করতে হবে
২. ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করার অনুমতি দিতে হবে
৩. আহত লোকজনের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে
৪. নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিতে হবে
৫. অভিযুক্ত বিপ্লব চন্দ্র শুভর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ফাঁসি দিতে হবে এবং
৬. গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে
এই দাবি প্রশাসন মেনে নিয়েছে। তারা কেবল বলেছে, ফাঁসি নয়, যেই অপরাধী শনাক্ত হোক না কেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হবে। দাবি মেনে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতার পর তৌহিদী জনতা আজকের সমাবেশ বাতিল করেছে।
তৌহিদি জনতার নেতারা আজ বেলা সাড়ে ১১টায় ভোলা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো তারা (প্রশাসন) মেনে নেওয়ায় আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ করিনি।’
বোরহানউদ্দিন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল আজিজ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ৪-৫ হাজার মানুষকে আসামি করে পুলিশ অ্যাসল্ট মামলা করেছেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গতকাল সমাবেশ চলাকালে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ একটি মসজিদের দোতলায় আশ্রয় নিলেও তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এ মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।
ভোর থেকে ভোলা শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে এবং সরকারি স্কুলের মাঠে ব্যাপক পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ভোলা চরফ্যাশন আন্তমহাসড়কে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বোরহানউদ্দিনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) টহল দিচ্ছে। পরিস্থিতি শান্ত। দুপুর পর্যন্ত কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। হতাহত লোকজনের বাড়িতে মাতম চলছে।
আহত লোকজন ভোলা সদর হাসপাতাল এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ভোলা এবং বোরহানউদ্দিনে চিকিৎসক সংকটের অভিযোগ করেছে রোগী ও তাঁদের পরিবার।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন রথীন্দ্রনাথ মজুমদার বলেছেন, ভোলার আশপাশের হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক কর্মরত ছিলেন, তাঁদের ভোলায় আনা হয়েছে। তবে আহত লোকজনের সংখ্যা অনুযায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা যথেষ্ট না। তবে তাদের আন্তরিকতায় কোনো কমতি নাই নেই বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।
অভিযোগ উঠেছে, শুক্রবার বিকেলে বিপ্লব চন্দ্র শুভর নিজের ছবিসংবলিত ফেসবুক আইডি থেকে আল্লাহ ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে গালাগাল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে কয়েকজন ফেসবুক বন্ধুর কাছে মেসেজ পাঠানো হয়। যাদের মেসেজ পাঠানো হয়, তারা এর স্ক্রিনশট নিয়ে ফেসবুকে দিলে লোকজন প্রতিবাদ জানানো শুরু করেন। বিষয়টি পুলিশের নজরে আসে। এ নিয়ে বিভিন্ন মসজিদ থেকে কয়েক দফায় বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। শুক্রবার সন্ধ্যার পর বিপ্লব চন্দ্র বোরহানউদ্দিন থানায় তাঁর আইডি হ্যাক হয়েছে মর্মে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে আসেন। এ সময় পুলিশ বিষয়টি তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিপ্লব চন্দ্রকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আল্লাহ ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক ব্যক্তির বিচারের দাবিতে গতকাল ঈদগাহ মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে তৌহিদি জনতা। এ সমাবেশের জন্য পুলিশ অনুমতি দেওয়ার আগেই তারা মাইকিং করে। পরে সমাবেশের জন্য পুলিশ অনুমতি না দিলেও সকাল নয়টা থেকে লোকজন মাঠে জড়ো হতে থাকে। মিছিল করতে না পেরে সেখানেই অবস্থান শুরু করে তারা। পরে পুলিশ ‘বাটামারা পীর সাহেব’ মাওলানা মহিবুল্লাহকে সেখান থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করে এবং তাঁকে ঈদগাহ জামে মসজিদের দোতলায় নিয়ে যায়। ওই সময় গুঞ্জন ওঠে, মাওলানা মহিবুল্লাহকে পুলিশ আটক করেছে। এ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি ছুড়লে চারজন নিহত হন।
পুলিশের দাবি, উত্তেজিত লোকজন পুলিশের ওপর হামলা করলে তারা গুলি করতে বাধ্য হয়।